অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের বিদায়ের পর কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক প্রজ্ঞার সামগ্রিক পরিমাণ কত দাঁড়াইল, নরেন্দ্র মোদী তাহার হিসাব ত্রৈরাশিকে না কষিয়া ভগ্নাংশেই কষিলে ভাল করিবেন। তাঁহার আমলে প্রথমে বিদায় লইয়াছিলেন রঘুরাম রাজন। তাহার পর গেলেন অরবিন্দ পানাগড়িয়া। অবশেষে সুব্রহ্মণ্যন। অতঃপর কি সুব্রহ্মণ্যম স্বামীই ভরসা? প্রসঙ্গটি অবশ্য লঘু রসিকতার নহে। রঘুরাম রাজনের ন্যায় সর্বজনমান্য অর্থনীতিবিদ, অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের ন্যায় প্রথিতযশা অধ্যাপক, এমনকি পানাগড়িয়ার ন্যায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন অধ্যাপনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অর্থনীতিবিদকেও কেন কেন্দ্রীয় সরকার ধরিয়া রাখিতে পারে না? উল্লেখ্য, বিদায়কালে কেহই সরকারকে দোষ দেন নাই, প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত কারণের কথা বলিয়াছেন। কিন্তু তাহার পরও প্রশ্ন থাকে। প্রথম প্রশ্ন, ‘ব্যক্তিগত কারণ’গুলি কি সত্যই প্রকৃত কারণ, না কি তাহা নিছক সৌজন্য? নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ্যে না আনিবার ভদ্রতাবোধ? এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া অসম্ভব, ভারতবাসী কেবল অনুমান করিতে পারে। কিন্তু, ‘ব্যক্তিগত কারণ’গুলিকে অতিক্রম করিয়াও তাঁহারা থাকিয়া যাইবেন, এমন পরিবেশ যে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে নাই, এই কথাটি বুঝিতে অনুমানশক্তির প্রয়োজন পড়ে না। এবং, তাহা এই সরকারের পক্ষে ইতিবাচক বিজ্ঞাপন নহে। প্রধানমন্ত্রীর সহিত দ্বিমত পোষণ, বা নাগপুরগন্ধী চিন্তার বাহিরে ভাবিবার প্রবণতা— দৃশ্যত সবই অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।
দিন কয়েক পূর্বেই যুগ্মসচিব পদে ‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’ অর্থাৎ অন্য ক্ষেত্র হইতে সমান্তরাল প্রবেশের দরজা খুলিয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার। ঘোষিত উদ্দেশ্য, আমলাতন্ত্রের অচলায়তনে মুক্ত হাওয়া খেলাইয়া দেওয়া। রসিকতা হিসাবে চমৎকার, অস্বীকার করিবার উপায় নাই। যে সরকার বিরুদ্ধ মত শুনিতে প্রস্তুতই নহে, এমনকি অমর্ত্য সেনের মতামতকেও যাহারা হেলায় উড়াইয়া দিতে পারে, সেই সরকার নাকি মুক্ত চিন্তার আবাহন করিবে! জগদীশ ভগবতীর ন্যায় সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বলিয়া পরিচিত পণ্ডিতও যদি খানিক বেসুরো গাহেন, জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীদের নিকট তাহাও অসহ্য। ভিন্ন মতকে জায়গা করিয়া দেওয়ার মতো উদারতাই যদি না থাকে, আলোচনার গণতান্ত্রিক পরিসরটি যদি প্রতি নিয়ত খণ্ডিত হইতে থাকে, তবে মুক্ত চিন্তার খোলা হাওয়া খেলিবে কোথায়? যে স্তরেই সমান্তরাল প্রবেশ ঘটুক, হয় ঘোষিত উদ্দেশ্যটি ব্যর্থ হইবে, অথবা পদে অধিষ্ঠিত হইবেন নাগপুরের আশীর্বাদধন্যরা। দুর্জনে বলিবে, সমান্তরাল প্রবেশের উদ্দেশ্যটি ইহা ভিন্ন কখনও অন্য কিছু ছিল না।
স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক অশ্বিনী মহাজনের মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করিয়াছেন, অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের ছাড়িয়া যাওয়া পদে এমন কাহাকে আনা হউক, ভারতীয় কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতি যাঁহার বিশ্বাস আছে, এবং যিনি কোনও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ছুটি লইয়া আসিবেন না। অনুমান করা চলে, মহাজনের দেখানো পথটিতে চলিতে নরেন্দ্র মোদীরও বিশেষ আপত্তি থাকিবে না। ভারতের আমজনতার প্রতি সহানুভূতিশীল হইতে যে নাগপুরের গোশালায় দুধ দুহাইবার অনুশীলন করিতে হয় না, এবং মেধা ও প্রজ্ঞা যে গৈরিক জাতীয়তাবাদের গণ্ডি মানিয়া চলে না, এই সহজ কথাগুলিও যাঁহারা বোঝেন না, ভারতীয় অর্থনীতি তাঁহাদের অঙ্গুলিহেলনেই চলে। তাঁহাদের আপত্তিতেই বিশ্বমানের পণ্ডিতরা মানে মানে পলাইয়া বাঁচেন। ময়দান এখন ফাঁকা। সুব্রহ্মণ্যম স্বামীরাই কান্ডারি হইবেন। অর্থনীতির জাহাজের ভরাডুবি ঠেকাইবে কে, সেই ভাবনা অবশ্য নরেন্দ্র মোদীর নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy