করাচির রাস্তায় কট্টরপন্থীদের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি।
মৃত্যুদণ্ড রদ হইল, কিন্তু আসিয়া বিবি কি রক্ষা পাইবেন? পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ধর্মদ্রোহের অভিযোগ হইতে তাঁহাকে মুক্তি দিয়াছে। বিচারপতিরা বলিয়াছেন, সহনশীলতাই ইসলামের ভিত্তি। কিন্তু এই রায়ের প্রতিবাদে দেশ জুড়িয়া বিক্ষোভ ছড়াইয়াছে। আট বৎসর কারাবাসের পর চার সন্তানকে লইয়া আসিয়া বিবি শান্তিতে বাঁচিবেন, এমন আশা কম। যাঁহারা তাঁহাকে নিরাপত্তা দিবার চেষ্টা করিবেন, তাঁহারাও ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের রোষের সম্মুখে পড়িতে পারেন। ইতিপূর্বে আসিয়া বিবিকে সমর্থন করিয়া, এবং ধর্মদ্রোহে অভিযুক্তকে চরম শাস্তি দিবার বিরোধিতা করিয়া দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রাণ হারাইয়াছেন— পঞ্জাব প্রদেশের প্রাক্তন গভর্নর সলমন তাসির এবং মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি। ২০১১-র ওই দুইটি হত্যা গোটা বিশ্বকেই স্তম্ভিত করিয়াছিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সহিত পাকিস্তানের আইনের সংঘাতও সম্মুখে আসিয়াছিল। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস ধর্মদ্রোহিতার বেশ কিছু মামলার ঘটনাক্রম বিবেচনা করিয়া জানাইয়াছে, পাকিস্তানে ধর্মদ্রোহ আইন বলবৎ করিবার প্রক্রিয়া বাক্স্বাধীনতার অধিকার এবং ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের অধিকার লঙ্ঘন করিতেছে। আইনজীবীর সহায়তা হইতে অভিযুক্তদের বঞ্চনা, বিচারাধীন অবস্থায় দীর্ঘ দিনের বন্দিত্ব, ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত এবং বিচারে পক্ষপাত, এমন নানা সঙ্কট দেখা যাইতেছে। আসিয়া বিবির মামলাতেও তাহার ইঙ্গিত মিলিল। যে সকল সাক্ষ্যের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত এবং লাহৌর হাইকোর্ট আসিয়া বিবিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়াছিল, সেগুলি নির্ভরযোগ্যতার অভাবে খারিজ হইয়াছে শীর্ষ আদালতে।
আসল বিপদ কারাগারের অন্দরে নহে। এই অবধি আদালতের রায়ে ধর্মদ্রোহের দায়ে এক জনেরও মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা পালিত হয় নাই। লাহৌরের একটি অসরকারি সংস্থার মতে, ১৯৮৭ সাল হইতে ষাট জনেরও অধিক ব্যক্তির মৃত্যু হইয়াছে ধর্মদ্রোহের অপরাধে, অধিকাংশই নিহত হইয়াছেন তথাকথিত গণরোষে। তাঁহাদের মধ্যে সকল সম্প্রদায়ের মানুষই আছেন, কিন্তু জনসংখ্যায় অনুপাতের নিরিখে অ-মুসলিমদের সংখ্যা বেশি। আসিয়া বিবিও খ্রিস্টান। তিনি বরাবর দাবি করিয়াছেন, সামান্য কলহের জেরে প্রতিবেশীরা ধর্মদ্রোহের অভিযোগ আনিয়াছে। আদালতে দীর্ঘ দিন বন্দি থাকিবার দুঃখ পাইলেও আসিয়া বিবি শেষ পর্যন্ত বিচার পাইয়াছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মদ্রোহের গুজব হইতেই বিদ্বেষের আগুন ছড়াইয়াছে, ইটভাটার শ্রমিক হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আদালত অবধি পৌঁছাইতেও পারেন নাই। ‘উন্মত্ত জনতা’র বিদ্বেষবহ্নি তাঁহাদের গ্রাস করিয়াছে। ভারতবাসীর নিকট এই ঘটনাক্রম অপরিচিত নহে। গোহত্যা, গোমাংস ভক্ষণের অভিযোগে কখনও পশু ব্যবসায়ী, কখনও গৃহস্থ, কখনও মাংস বিক্রেতাকে গণপ্রহার ও হত্যার ঘটনা এই দেশে অধুনা সুলভ। এই দেশেও আদালত এবং নাগরিক সমাজের একাংশ হিন্দুধর্মের ভিত্তিস্বরূপ সহনশীলতার আদর্শের কথা মনে করাইয়াছেন। কিন্তু হিন্দুত্বের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি তাহাকে উপেক্ষা করিয়াছে।
মূল প্রশ্নটি ধর্মদ্রোহের ধারণা লইয়াই। এই মধ্যযুগীয় ধারণা যে আজও নানা দেশেই প্রচলিত এবং স্বীকৃত, তাহাই মানবসভ্যতার পক্ষে কলঙ্কস্বরূপ। বহু শত বৎসর, বহু লক্ষ মানুষের মধ্যে যে ধর্ম বাঁচিয়া রহিয়াছে, বহু জনহিতকর কাজে অগণিত নরনারীকে যে ধর্মবিশ্বাস প্রণোদিত করিতেছে, কাহারও অসতর্ক মন্তব্যে সেই ধর্মের অপূরণীয় ক্ষতি হইবে, এমন চিন্তাই বাতুলতা। সন্দেহ নাই, সমালোচনা বা নিন্দায় সমস্যা ধর্মের নহে, ধর্মের ধ্বজা ধরিয়া যাঁহারা প্রতিপত্তি বজায় রাখিতে তৎপর, সমস্যা তাঁহাদের। ধর্মদ্রোহ আইন তাঁহাদের স্বার্থ সিদ্ধ করে। এই আইন এবং তাহার প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ অপেক্ষা বড় অধর্ম কমই আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy