Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

নির্বাচন, সাংবাদিক ও সেনা

‘ডন’ পাকিস্তানের অন্যতম প্রাচীন, বিখ্যাত কাগজ, তার প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং মহম্মদ আলি জিন্না। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা ছিল এই কাগজের। আজ কাগজেরই স্বাধীনতা আক্রান্ত।

আলি হায়দার
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন ২৫ জুলাই। তার আগে সংবাদমাধ্যমের উপর যে ধরনের সেন্সরশিপ নেমে এসেছে, তা অভূতপূর্ব বলে দাবি করছেন অনেকে। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য আই এ রহমান যেমন বলেছেন, জেনারেল জ়িয়া উল হকের শাসনকালকেই সাধারণত মিডিয়ার পক্ষে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়, কিন্তু বর্তমান সময় আরও ভয়ানক। সেই সময়ে সাংবাদিকদের ভয় দেখানো, সংবাদ সেন্সর করা, সবই হত। কিন্তু গোয়েন্দা এজেন্সিরা এখন যে ভাবে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা আর এক ধাপ উপরে।

কেমন সে নিয়ন্ত্রণ? সংবাদপত্র ‘ডেলি ডন’-এর সিইও হামিদ হারুন গত মাসে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকাগুলোতে অনেক মাস ধরেই তাঁদের কাগজ ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। এখন সিন্ধ, বালুচিস্তান, পঞ্জাবের বিভিন্ন নাগরিক এলাকাতেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে হকার ও এজেন্টদের। হারুন সরাসরি সামরিক বাহিনীর নাম করেননি। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের তরফে এই আক্রমণ নয়, অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান আছে এর পিছনে। ‘ডন’ পাকিস্তানের অন্যতম প্রাচীন, বিখ্যাত কাগজ, তার প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং মহম্মদ আলি জিন্না। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা ছিল এই কাগজের। আজ কাগজেরই স্বাধীনতা আক্রান্ত।

হারুন জানিয়েছেন, কোনও খবরে সেনাবাহিনী, বা কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমালোচনা থাকলেই সেগুলো বাদ দিতে বা তার অংশবিশেষ ‘সেন্সর’ করতে চাপ দেয় পাক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস (আইএস)-এর জনসংযোগ দফতর। ওই দফতরের কর্তা আসিফ গফুর ‘ডন’ সংবাদগোষ্ঠীর ‘হেরল্ড’ পত্রিকার সম্পাদককে হুমকি দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ। কারণ ওই পত্রিকায় ‘পাশতুন তাহাফুজ় আন্দোলন’ সম্পর্কে লেখা ছাপা হয়েছিল। ওই আন্দোলন জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় সেনার কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সামরিক বাহিনীর দায়বদ্ধতা দাবি করে।

ভীতিপ্রদর্শনের অনেক অভিযোগ গফুরের বিরুদ্ধে। এর আগে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার লেখকদের ‘শিক্ষা দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছিলেন। ‘আপনারা কারা, আমরা জানি’, বলে তিনি একটা গ্রাফ দেখিয়েছিলেন, যেখানে বেশ কিছু ব্লগারকে শনাক্ত করা হয়েছে— এঁরা তাঁদের ব্লগে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সেনার নাক গলানোর বিরোধিতা করছেন। সে দিন যাঁদের পরিচয় ফাঁস করা হয়েছিল, এমন এক ব্লগারকে পরে সেনাবাহিনী বন্দি করেছে। আর এক মহিলা সাংবাদিকের বাড়িতে হানা দিয়ে নয়ছয় করা হয়েছে জিনিসপত্র। আক্রান্ত হচ্ছেন তরুণরাও। সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে পাক সামরিক বাহিনী— টুইট করেন এক তরুণী। করাচির ব্যস্ত রাস্তায় তাঁকে দুই ব্যক্তি হুমকি দেয়, মুখ বন্ধ না করলে বিপদ হবে। তাঁর পরিবার জানিয়েছে, বছর বাইশের মেয়েটি শীঘ্রই দেশ ছাড়বে।

সামরিক বাহিনী যেন ঠিক করে নিয়েছে কী হবে দেশের ভবিষ্যৎ, মিডিয়াকে সেই চিত্রনাট্য মেনে চলতে হবে। পাকিস্তানের বৃহত্তম সংবাদগোষ্ঠী ‘জং’ গ্রুপ গোড়ায় সেই নির্দেশ মানতে চায়নি। কিন্তু এমন চাপ তৈরি হল, তাঁরা নতিস্বীকারে বাধ্য হলেন। জং-এর প্রবীণ কর্মী তালাত আসলাম জানালেন, সাংবাদিকদের যখন তখন তুলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল, চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করা হচ্ছিল। খবরের কাগজের গোছা নামিয়ে দিতে বাধ্য করা হত হকারদের, বিজ্ঞাপন না দিতে বলা হত বাণিজ্যিক সংস্থাকে। শেষ অবধি বাইশ দফা শর্ত মেনে নেয় জং গোষ্ঠী। যথা সেনাবাহিনী, প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করে কিছু লেখা যাবে না, তাদের বোঝাপড়া নিয়ে কিছু লেখা যাবে না, ইমরান খান সম্পর্কে ইতিবাচক খবর করতে হবে। আসলামের মতে, জং গোষ্ঠী কার্যত এই সব শর্ত মেনে নিয়েই ফের কাজ করতে পারে। অন্যান্য সংবাদগোষ্ঠী সেই নজিরই অনুসরণ করেছে।

নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বালুচিস্তানের উপর খবর কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে মিডিয়াতে। অথচ সেখানে চলছে জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান। খাইবার-পাখতুনখোয়া অঞ্চলে পাশতুন তাহাফুজ় আন্দোলন সম্পর্কেও সংবাদ বেরোচ্ছে না। কেন প্রধান প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের থেকে দলে দলে সমর্থক সরে আসছেন, সে বিষয়ে কোনও রিপোর্ট থাকছে না কাগজে। যদিও সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই লিখছেন, আইএসআই তাঁদের বাধ্য করছে নওয়াজ় শরিফের দল ছেড়ে ইমরান খানের দলে যোগ দিতে। ‘‘আমরা দেখব, নির্বাচন চুরি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তা নিয়ে খবর করতে পারবে না মিডিয়া’’, বলেন এক পর্যবেক্ষক। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান জ়ায়দি মনে করেন, নির্বাচনে ত্রিশঙ্কু দশা হবে পার্লামেন্টের, সেনাবাহিনী তখন আড়ালে থেকে সরকার গঠনে প্রধান শক্তি হয়ে উঠবে।

সেনাবাহিনী এখন তালিকা চেয়ে পাঠাচ্ছে, কোন কোন রিপোর্টার নির্বাচনের খবর করবেন। তালিকা ‘অনুমোদন’ করবে সেনা। ‘পাকিস্তান-বিরোধী’ কোনও সাংবাদিক নির্বাচনের খবর করুক, চায় না সেনা। আধা-সামরিক ‘রেঞ্জার’দের ছোট ছোট দল নাকি মোতায়েন করা হবে প্রধান প্রধান নিউজ় রুমের সামনে।

বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গণতন্ত্রের কাছে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?

করাচিতে কর্মরত পাকিস্তানি সাংবাদিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Media Censorship Daily Dawn Military Election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE