Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

ভয় বাংলা

‘ভয় বাংলা’য় আক্রান্ত নেতারা বুঝিয়াছেন, নিজের পদ হারাইবার ভয়ের নিকট অপরের প্রাণ হারাইবার ভয় তুচ্ছ। মূর্খ নাগরিকরা তাহা বুঝেন নাই।

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০৭
Share: Save:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্ব বাংলায় এক নূতন রোগ দেখা দিয়াছে। তাহার নাম ‘ভয় বাংলা।’ ভর্ৎসনার ভয় হইতে তাহার উৎপত্তি, লক্ষণ উলটাবুদ্ধি। ইহার সংক্রমণ হইলে ডেঙ্গিকে মনে হয় ‘অজানা জ্বর,’ কলিফর্ম-দূষিত নলকূপের জল ‘বিশুদ্ধ’ বলিয়া বোধহয়। মশামাছিগুলাকে বিরোধীদের পোষ্য, আটাকে ব্লিচিং পাউডার, মহামারিকে সংবাদমাধ্যমের অপপ্রচার বলিয়া মনে হইতে থাকে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ সর্বাধিক। তাই মেয়র মহোদয়কে সকলে ভুল বুঝিতেছে। তাঁহার কী দোষ? জনপ্রতিনিধির কাজ জনগণকে আশ্বস্ত করা। সেই নিয়ম মানিয়াই তিনি বলিয়াছিলেন, পুরসভার জলে জীবাণু নাই। জীবাণু ক্ষুদ্র, নেতা বৃহৎ, অতএব জীবাণুকেই অস্বীকার করিতে হইবে। পরীক্ষায় যদি কলিফর্ম বা ই-কোলাই মিলিয়া থাকে, তবে দেখিতে হইবে, পরীক্ষাকেন্দ্রটি কাহাদের, পরীক্ষক কাহারা, কোন সাহসে তাঁহারা ওই রিপোর্ট লিখিতে পারিলেন! স্বাস্থ্য দফতরের অধিকর্তা আবার জল ফুটাইয়া খাইতে বলিয়াছেন। কী সাহস! ছয় দিনে মাত্র আটশো মানুষ দাস্ত-বমি করিয়া কাহিল হইয়াছে। কয়েক হাজার হাসপাতাল-শয্যার মাত্র পঁচাত্তর-আশিটি দখল করিয়াছে আন্ত্রিকের রোগীরা। এক জন না-হয় মারাই গিয়াছে। তাই বলিয়া পুরসভার নির্মল জল ফুটাইয়া খাইতে বলিতে হইবে?

‘ভয় বাংলা’য় আক্রান্ত নেতারা বুঝিয়াছেন, নিজের পদ হারাইবার ভয়ের নিকট অপরের প্রাণ হারাইবার ভয় তুচ্ছ। মূর্খ নাগরিকরা তাহা বুঝেন নাই। তাই দরিদ্র বস্তিবাসীও বহু অর্থব্যয়ে বোতলের জল কিনিতেছেন। সুযোগ বুঝিয়া ব্যবসায়ীরা বোতলে পুরসভার জল ভরিয়া বিক্রয় করিতেছেন। পুরকর্তাদের কর্তব্য ছিল পরীক্ষিত, নিরাপদ পানীয় জলের ট্যাঙ্কার আক্রান্ত এলাকায় পাঠানো। কিন্তু ‘ভয় বাংলা’ তাঁহাদের জড়বুদ্ধি করিয়াছে। পানীয় জল নিরাপদ কি না, সেই বিষয়ে নেতারা সিদ্ধান্ত না জানাইলে তাঁহারা কী করিতে পারেন? গত বৎসরের অভিজ্ঞতা হইতে তাঁহারা শিক্ষা লইয়াছেন। মশাবাহিত রোগকে ‘অজানা জ্বর’ লিখিতে চিকিৎসকদের উপর প্রবল চাপ দিয়াছিল সরকার। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে কেবল অণুচক্রিকার স্বল্পতা লিখিবার অনুমতি মিলিয়াছিল, ‘ডেঙ্গি’ নির্দিষ্ট করিবার অনুমোদন মিলে নাই। মৃত্যুর কারণ হিসাবে সার্টিফিকেটে ডেঙ্গি সংক্রমণ লিখিবার সাহস কাহারও হয় নাই। এখন আন্ত্রিকের ক্ষেত্রেও ভয়ানক চিত্রনাট্য পুনরভিনীত হইতেছে। শহরে এক জনের মৃত্যুর পর এক পুরকর্তা বলিয়াছেন, ডেথ সার্টিফিকেট না পাইলে কিছু বলা যাইবে না!

আতঙ্কই এখন বাংলার পরিচয়। তাই নেতারা দায় এড়াইবার ব্যস্ততায় কর্তব্য করিবার সময় পান না। অথচ কাজ কম নহে। জনস্বাস্থ্যের সকল দিকেই এ-রাজ্যে অগণিত ত্রুটি। রাস্তার দুই ধারে উন্মুক্ত নিকাশিনালা, স্তূপাকার আবর্জনা, অগণিত মশামাছি, উন্মুক্ত শৌচ— প্রতিটিই মহামারিকে আমন্ত্রণ করিতেছে। কিন্তু এইগুলিকে মানিলে ব্যর্থতা স্বীকার করা হয়, এমন ভাবিলে সমাধান হইবে কী করিয়া? তীর্থস্থানের জল দূষিত, তাহা বলিবার অপরাধে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে এক চিকিৎসককে ‘গণশত্রু’ চিহ্নিত করিয়াছিলেন পুরকর্তারা। আজ পুরসভার জলকে দূষিত বলিবার কাজটি তেমনই ঝুঁকিপূর্ণ হইয়াছে। ‘ভয় বাংলা’র প্রতিষেধক কে দিবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

diarrhoea Drinking Water KMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE