সাধুবাদ পাচ্ছে মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়— ক্লাস ওয়ান, টু-এর পড়ুয়াদের হোমটাস্ক দেওয়া যাবে না। ব্যাগের ওজন কমাতে হবে, মূল্যায়নের চাপ কমাতে হবে, এ ধরনের সুপারিশও আছে। স্কুলব্যাগের ওজন, পড়াশোনার চাপ নিয়ে শিক্ষাবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ, শিশু-চিকিৎসকরা বহু দিনই কথা বলেছেন। এই রায়ে তা স্বীকৃতি পেল।
শিশুরা রেহাই পেল কি? অবশ্যই হোমটাস্ক বা বাড়ির কাজ একটা বড় চাপ। মাদ্রাজ হাইকোর্টের এই রায় উপযুক্ত ভাবে প্রয়োগ করা হলে শিক্ষাজগতের কিছু সমস্যা সমাধানের আশা করা যায়। তবু কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। বাড়ির কাজ আনবে না শিশুটি, কিন্তু তার সিলেবাসের ভার কমবে কি? সে ভার কমানোর কথা বার বার বলা হতে থাকে, কিন্তু সে ব্যাপারে অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনও যথার্থ পরিবর্তনসাধক পদক্ষেপ করা হয়নি আজও।
তা হলে ধরে নিতে হবে, হোমটাস্ক না থাকলেও বাচ্চাটিকে স্কুলে সবটাই পড়তে হচ্ছে। সব ছাত্রছাত্রী সমান গতিতে বোঝে না, তা আমরা শিক্ষকশিক্ষিকা মাত্রেই জানি। ছোটদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও গুরুতর হয়। এ বার নির্দিষ্ট ভাবে পরীক্ষা নেওয়া হোক বা না হোক, কোনও না কোনও মূল্যায়ন তো হচ্ছে। বাড়িতে কাজ দেওয়া হয়নি, মা বাবা তৈরি করে পাঠাতে পারেননি। কিন্তু মূল্যায়নের ফলাফল মাঝবছরে বা বছরের শেষে বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছচ্ছে। পেরেন্ট টিচার্স মিটিংয়ে শিক্ষিকা আপনাকে জানাচ্ছেন যে আপনার সন্তান অঙ্কে দুর্বল, বা তার জেনারেল নলেজ বাড়ানো উচিত। এটাও দেখতে পারছেন যে বাচ্চাটির সহপাঠী বা সহপাঠিনীর বাবা মা খুব হাসিমুখে শিক্ষিকার সঙ্গে কথা বলছেন। আপনি চিন্তিত হলেন, সেই বন্ধু কোন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে তার খোঁজ নিতে শুরু করলেন এবং তার অঙ্ক, জেনারেল নলেজ বাড়াবার আর কী উপায় নেওয়া যায়, সেটা ভাবতে থাকলেন। হোমটাস্ক না আসার জন্য যে অতিরিক্ত এক ঘণ্টার ছুটি বাচ্চাটির বরাদ্দ হয়েছিল, সেটা কাটা পড়ল।
আর যদি এমন হয়, যে আপনার সন্তান স্কুলে যা শেখানো হয় তার ভিত্তিতে স্কুলের মূল্যায়নে ভাল ফল করছে, তা হলে আরও ভাল করতে পারার ভারটা থেকেই যাচ্ছে। তা ছাড়া যে মুহূর্তে আপনি শিক্ষিকাদের থেকে জানতে পারছেন আপনার ছেলে বা মেয়ে বেশ একটু এগিয়ে আছে, আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। তাই ক্লাসে অঙ্ক করতে পেরেও তার রেহাই নেই, সে যেন আরও ভাল অঙ্ক করতে পারে, ভাল করতেই থাকে, তার জন্য আপনি লড়তে শুরু করবেন। তা ছাড়া আঁকা, গান ইত্যাদি শেখার চাপ তো আছেই।
শিশু যত ছোটই হোক, সাফল্য ও ব্যর্থতা, আদর ও অনাদরের পার্থক্য বোঝে। দেখেছি, তিন সাড়ে তিন বছরের অনেকগুলি ছোট বাচ্চা স্কুলের বাস থেকে নামল। সে দিনকার প্রজেক্ট ছিল আইসক্রিমের কাঠির তৈরি পুতুল। স্কুলের শিক্ষিকা কারও পুতুলের গায়ে ‘স্মাইলি’ এঁকে দিয়েছেন, কারওটাতে আঁকেননি। যে স্মাইলি পেয়েছে, সে খুব খুশি। তার মা-ও খুশি। একটি শিশুর পুতুলের হাত হয়তো একটু বেঁকে গিয়েছে, তাই তার স্মাইলি নেই। বাচ্চাটির মা স্মাইলি পাওয়া পুতুলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন। ছোট বাচ্চাটিও মায়ের মুখ দেখছে। ছোট্ট মুখ হাসবে কি হাসবে না ভাবছে।
এই সমস্যার সমাধান মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়ে নেই। সমাধান আছে আমাদের, বাবা-মায়েদের হাতে। শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষকশিক্ষিকা, স্কুল, তাদের ক্লাসের কাজ ও বাড়ির কাজের ভারসাম্য, এ সবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে কাজটা আমরা বাবা-মায়েরা করতে পারি, তা কোনও স্কুল করতে পারে না। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের তৈরি করা এবড়োখেবড়ো পুতুল দেখে এক গাল হাসতে পারি। সেটিকে ড্রয়িংরুমের মাঝখানে জায়গা দিতে পারি। তা হলে, ভবিষ্যতে যখন তার অঙ্ক পরীক্ষার গ্রেড অত ভাল হবে না, তখন সে খাতা লুকোবে না, নিশ্চিন্তে আপনাকে এনে দেখাবে। আমাদের ছেলে বা মেয়ে যেমন পুতুলই বানাক, যেমন রেজ়াল্টই করুক, তারা আমাদের খুব প্রিয়, খুব আদরের।
এই কথাটা আমরা বাবা-মায়েরা জানি, অনুভব করি। শুধু এই গোলমেলে সময়ের চাপে, প্রতিযোগিতা নামের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার চাপে ভুলে না যাই— এটাই আমাদের কাজ। বাড়ির কাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy