চিনদেশের একটি প্রবাদপ্রতিম অভিশাপ হল— ‘তুমি এক আশ্চর্য সময়ের মধ্যে দিয়ে যাও’। আপাত ভাবে শুনলে এটি আশীর্বাদ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কার্যত এটি ঠিক তার উলটো। এটি আসলে একটি বক্রোক্তি। যাকে উদ্দেশ্য করে এটি বলা হয়, তাকে এর দ্বারা এক শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবন থেকে বিচ্যুত হওয়ার অভিশাপই দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তার জীবন ক্ষতবিক্ষত এবং দুর্যোগপূর্ণ হোক।
কেউ সাম্প্রতিক সময়ের সংবাদ শিরোনামগুলিকে লক্ষ করলে তাঁর মনে এমন প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, আমরা কি সেই প্রাচীন চিনা অভিশাপে বর্ণিত ‘আশ্চর্য সময়’-এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি? এমন এক সময়, যখন সঙ্কটের পর সঙ্কট ক্রমাগত মাথাচাড়া দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা অথবা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলি যথাযথ ভাবে সেগুলির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে প্রথমে সাইবেরিয়া বা উত্তর-পশ্চিম কানাডার উষ্ণতার তরঙ্গ এবং দাবানল (অন্যত্রও বটে)-কে ধরা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ইওরোপের আধ ডজন দেশে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির কথাও মনে করা যেতে পারে। যে সব দেশের বাসিন্দারা এমন বন্যার খবর কেবল সংবাদমাধ্যম মারফত জেনে থাকতেন এবং যাঁদের ধারণা ছিল, এ সব কেবল বহুদূরের দেশে হয়ে থাকে, যাদের সম্পর্কে তাঁদের খুব স্পষ্ট ধারণা নেই।
এর পরে আমাদের সামনে চিকিৎসাবিজ্ঞান এক প্রায়-স্থায়ী সাবধানবাণী শুনিয়ে রেখেছে। সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হুমকি দিচ্ছে, এক ‘অমর ভাইরাস’ তার প্রায় এক ডজন প্রজাতিকে নিয়ে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। যার বিপরীতে কোনও ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বা সমষ্টিগত প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করা সে ভাবে সম্ভব নয়। ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ জানাচ্ছে, ‘সার্স-কোভ-২ ভাইরাস মরবে তো না-ই, বরং তা আগামী বছরগুলিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পিংপং বলের মতো এ দিক ও দিক দৌড়ে বেড়াবে।’ এ কথার সারবত্তা এই যে, যাকে একদা ‘স্বাভাবিক জীবন’ বলে মনে করা হত, সেই জীবনছন্দ খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে মনে হয় না। তৃতীয়ত, গণতন্ত্র এবং উদারপন্থার যুগ আপাত ভাবে মুক্ত সমাজগুলিতে ক্রমজায়মান ক্ষমতা, অস্বচ্ছতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার অভাবে উবে যেতে বসেছে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা সর্বত্রই নতুন প্রযুক্তি মারফত নজরদারির সমাজ গড়ে তুলছেন। দানবাকার কর্পোরেট সংস্থাগুলির শুঁড় ক্রমেই সর্বত্র প্রবেশ করছে। যা আপাতত ততটা ভয়ঙ্কর বলে মনে না হলেও চিন্তার বিষয় হয়ে তো দাঁড়াচ্ছেই। কোনও সংশোধনমূলক পদক্ষেপ না ঘটলে সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের বিভিন্ন রচনায় বর্ণিত ‘দুঃস্বপ্নের কাল’ নেমে আসা অসম্ভব নয়। চতুর্থত, যখন আঞ্চলিক স্তরে প্রভুত্বের উদ্দেশ্য নিয়ে চিনের বহুমুখী ক্ষমতার উত্থান শুরু হল, তখন তাকে আটকানোর জন্য আমেরিকার সংগ্রাম বিশ্বের ক্ষমতা-কাঠামোর মধ্যে এক পরিবর্তনকে দৃশ্যমান করে তুলল। তথাকথিত ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হল। এই ধরনের ক্ষমতাকেন্দ্রের বদল সাধারণত সামরিক সঙ্ঘাতের মাধ্যমেই দেখা যায়। নাৎসি জার্মানির উত্থানের পিছনে যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটা বড় ভূমিকা ছিল। এ কথা সহজেই অনুমেয়। মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে জাপানের উত্থান ছিল এক দশকব্যাপী রুশ-জাপান যুদ্ধের অপ্রত্যাশিত ফল।