Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
উত্তর সম্পাদকীয়

তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার গলায় পরিতে সুখ

শুধু রাজনীতি নয়, যে কোনও ক্ষমতাশালী মানুষের পায়ে পায়েই সব সময়ে কেচ্ছা ঘুরঘুর করে। কারণ তাঁদের কীর্তির চেয়ে কেচ্ছাটাই বেশি মনোরম যে! লিখছেন সায়ন্তনী পূততুন্ড প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়েই এত সব কাণ্ড! ও দিকে, কেউ হুল ফোটানোর হুমকি দিচ্ছেন। এ দিকে, কারও ‘বেড়ালের তালব্য শ’ অ্যাটিটিউড নিয়ে বসে থাকা। কেউ কেউ গলা তুলে স্ত্রী-পক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বলছেন— ‘সব ঝুট হ্যায়’।

সায়ন্তনী পূততুন্ড
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:৫৬
Share: Save:

অতঃপর, বৈশাখী ঝড়ে কানন বিপর্যস্ত!

নাহ, এই ঝড়ে গাই-গরু, জন-মনিষ্যি-বাড়িঘর কিছুই ওড়েনি। স্রেফ উড়ে গেল একটি চেয়ার। আর তাই নিয়েই ফের গজল্লা শুরু হয়েছে। চায়ের দোকানে ঠেক মারা ত্রিকালজ্ঞ মুনিঋষিদের তৃতীয় নয়ন উন্মীলিত হয়েছে। চতুর্দিকে এখন ফোটা-ফুটি কেস। শহরের প্রাক্তন মেয়রের মনে ফুল ফুটেছে বলে মিডিয়ায়, রাজনৈতিক মহলে পটকা ফুটছে। জনগণের মনে লাড্ডু ‘ফুটছে’ আর ব্যর্থ প্রেমিকদের ‘দিল’ ‘গার্ডেন গার্ডেন’… থুড়ি ‘কানন কানন’ হচ্ছে।

আর কী! প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়েই এত সব কাণ্ড! ও দিকে, কেউ হুল ফোটানোর হুমকি দিচ্ছেন। এ দিকে, কারও ‘বেড়ালের তালব্য শ’ অ্যাটিটিউড নিয়ে বসে থাকা। কেউ কেউ গলা তুলে স্ত্রী-পক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বলছেন— ‘সব ঝুট হ্যায়’। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কারা যেন সব প্রেমে পড়ে বলেছিল— রেললাইনে বডি দেব, মাথা দেব না! অর্থাৎ চেয়ার, সম্পর্ক, দুনিয়া, হিরে-জহরত-রত্ন গোল্লায় যাক— বৈশাখী হাওয়ার ঝড় উঠলে হাল ছেড়ে পালানো যাবে না। তা সে মাঝির জন্য যতই কাল-বৈশাখী ঝড় হোক না কেন! অন্য দিকে, পাবলিকের আবার রাজনীতিকদের সাঁইয়া অবতার মেনে নিতে মোক্ষম চাপ। সব মিলিয়ে যাকে বলে একেবারে ‘হরেন্ডাস’ ব্যাপার। তাই আপাতত একটু কালটিভেট করে দেখা যাক।

যদিও অনেকেই এ শুষ্ক হেমন্তে অকাল বসন্তের ফুল ফোটা মেনে নিতে পারছেন না, তবুও সুধীজন প্রেমে চোরকাঁটা সইতে পারেন না। তাঁরা ইতিমধ্যেই লায়লা-মজনু, হির-রঞ্ঝা, রোমিও-জুলিয়েটের পর নতুন খেতাব কী হতে চলেছে তা নিয়ে আলোচনায় বসে পড়েছেন। এবং ইতিহাসের সিলেবাসে এই প্রেমকাহিনি অবশ্যপাঠ্য করা উচিত বলে দাবি করতেও শুরু করেছেন। তবুও মনে খটকা লাগে, সত্যিই কি বিষয়টি এতখানি গুরুত্ব দাবি করে? এমন কি আদৌ প্রথম বার ঘটছে পৃথিবীতে? আমরা মুঘল-এ-আজ়মে দেখেছি সুন্দরী আনারকলিকে নিয়ে কী ভয়ানক ফাঁপরেই না পড়েছিলেন স্বয়ং শাহজাদা সেলিম, ওরফে সম্রাট জাহাঙ্গির! বিদ্রোহ তো তিনিও করেছিলেন! ফলস্বরূপ, প্রায় তাঁকে তোপের গোলাতেই ওড়ানোর ফুলপ্রুফ প্ল্যান করেছিলেন সম্রাট আকবর। শেষমেষ অবশ্য কোপটা আনারকলির উপর দিয়েই গেল! হায়দরাবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ কুতুবশাহি সুলতান মহম্মদ কুলি কুতুবশাহ সুন্দরী নর্তকী ভাগ্যমতীর প্রেমে পড়ে তখ্ত-তাজ, মসনদকে লাথি মেরে প্রেমিকাকে নিয়ে ধাঁ হয়ে গেলেন। নেহাত তাঁর বাবা ইব্রাহিম কুলি ‘ওরে, বিয়েই দেব— বাড়ি ফিরে আয়’ বলে টলে গেলেন, প্রেমিকা-সমেত বিদ্রোহী ছেলেকে ঘরে ফিরিয়েছিলেন বলে ট্র্যাজেডিটা আর হয়নি। শাহজাদা খুররম এবং আর্জুমন্দ বানোর প্রেমকাহিনির উপর দিয়েও কম ঝড়ঝাপটা যায়নি। দু’জনকে চিনতে পারলেন না? আজ্ঞে ওঁরাই পরবর্তী কালে সম্রাট শাহজাহান ও মুমতাজ নামে বিখ্যাত হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে বিখ্যাত হয়েছে তাজমহলও। কিন্তু এই তাজমহলের ব্যাকগ্রাউন্ডে যে প্রেমকাহিনিটি রয়েছে, সেটিকে বরবাদ করার জন্য রাজনৈতিক চক্রান্তও কিছু কম হয়নি। নুরজাহানের কল্যাণে আরেকটু হলেই লভ-স্টোরিটি বরবাদ হচ্ছিল। একটু হলেই ভারতসম্রাটের গদিটি ফসকে যাচ্ছিল শাহজাহানের হাত থেকে! যদিও শেষরক্ষা হয়েছে।

আরও পড়ুন: বিজেপির ‘বিপদ’ বোঝাতে কন্যাশ্রীদের ডাক মমতার

এমন নিদর্শন ভূরি ভূরি রয়েছে ইতিহাসে। ভালবাসার জন্য, সম্পর্কের জন্য প্রাণ-ধন-মসনদও তুচ্ছ করে ফেলেছিলেন অনেকেই। আর এ তো সামান্য একটা চেয়ার!

মজার কথা, প্রেম তখনই কেলেঙ্কারি বা কেচ্ছা হয়ে ওঠে, যখন তার পিছনে রাজনীতি এবং ক্ষমতার অবয়ব থাকে। আসলে আমাদের মানসিক গঠনটাই এমন। যেন রাজনীতিবিদেরা বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা কিছুতেই ভালবাসতে পারেন না! সে ক্ষমতা পজ়িটিভ বা নেগেটিভ যেমনই হোক না কেন! গাঁধীজি বা নেতাজি বিবাহিত পুরুষ ছিলেন। সন্তানও আছে তাঁদের। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ তাঁরাও মানুষই ছিলেন! কিন্তু আমরা কিছুতেই ভাবতে পারি না যে, তাঁরা তাঁদের স্ত্রীকে আদর করে একটি চুমু খেতে পারেন! আশ্চর্য বিষয়! দেশনায়কেরা সারা জীবন ধরে আন্দোলন করবেন, আমরণ অনশনে বসবেন, মার খেতে পারবেন, যুদ্ধ করতে পারবেন, গুলিতে মরতেও পারবেন— কিন্তু প্রেম? নৈব নৈব চ! তা হলেই আমরা কেচ্ছার পাহাড় বানিয়ে ফেলব! জওহরলাল নেহরু কারাগারে থাকুন, প্রধানমন্ত্রিত্ব করুন— ধন্য ধন্য করতে রাজি আছি। অথচ, লেডি মাউন্টব্যাটেনের বন্ধু বা অনুরাগী হলেই আমাদের গায়ে ছ্যাঁকা লেগে যায়! তখনই প্রেম কুৎসার রূপ ধরে বিষাক্ত ছোবল বসাতে শুরু করে। কীর্তিমান মানুষটির কীর্তির সম্মান না করতে পারি, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে কেচ্ছা করেই ছাড়ব! আমাদের সবার ভার্টিগোর সমস্যা! উচ্চতা পোষায় না, তাই হিমালয়কে টেথিস সাগর এবং টেথিসকে গোস্পদ বানিয়েই শান্তি! সেই জন্যই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি যখন মেরিলিন মনরোর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন কিংবা বিল ক্লিন্টন যখন মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, তখন প্রায় চিৎকার করেই বলে উঠি— ‘এই বার পেয়েছি!’

শুধু রাজনীতি নয়, যে কোনও ক্ষমতাশালী মানুষের পায়ে পায়েই সব সময়ে কেচ্ছা ঘুরঘুর করে। কারণ তাঁদের কীর্তির চেয়ে কেচ্ছাটাই বেশি মনোরম যে! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম, যৌনজীবন, আদরের দাগ-টাগ নিয়ে তো রীতিমতো মহাভারত হয়ে গেল! এমনকি, এই কেচ্ছার হাত থেকে রক্ষা পাননি স্বয়ং কিংবদন্তী নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানী— মাদাম কুরি! তাঁর সুপুত্রী ইভ কুরি মারি কুরির জীবনী লিখতে গিয়ে স্পষ্ট লিখেছেন যে, তাঁর মায়ের চরিত্রহনন করা হয়েছিল। অন্য এক জন সহযোগী বিজ্ঞানী বন্ধুর সঙ্গে জড়িয়ে এই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীকেও কলঙ্কিত করা হয়েছে। তার পিছনেও অবশ্য চলছিল অন্য এক রাজনীতি! পুরস্কারের রাজনীতি! উপরিউক্ত ব্যক্তিরা তো প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ! ‘পজ়িটিভ’ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। এ বার একটু ‘নেগেটিভ’ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের দিকেও দেখা যাক! এক জন প্রতিভাধর খুনি, ‘বিকিনি কিলার’ চার্লস শোভরাজকে দেখুন। তিনি খুন করেও অতটা কলঙ্কিত হননি, যতটা নিহিতা বিশ্বাসকে ভালবেসে হয়েছিলেন! ওসামা বিন লাদেন বোমা-টোমা ফেলে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে আর এমনকি অন্যায় করেছেন! তবে এতগুলো বিয়ে করার জন্য পারলে তাঁকে দশ বার ফাঁসিতে চড়ানো উচিত!

আরও পড়ুন: মোদীর অনুরোধেই বিজেপিতে যোগ দেবেন ‘নারেগা লেডি’

এটাই আসলে আমাদের মন ও মানসিকতা! সম্পর্ক যদি হত হরিপদ কেরানি আর পঞ্চুরানির ইন্টু-পিন্টু, তা হলে কারও কোনও মাথাব্যথাই থাকত না। কিন্তু যেহেতু নাম জড়িয়েছে এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের, সুতরাং তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে না! অতএব, তাঁকে যা খুশি তাই বলা যায়, সব কিছু করা যায়! ব্যক্তিগত জীবনকে টেনে এনে, কর্দমাক্ত করে, মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢালতে পারলেই ওঁ শান্তি! কখনই ভাবব না যে, রাজনীতিকও দোষ-গুণ সম্পন্ন একজন মানুষ! আসলে ‘কুর্সি’র সঙ্গে সঙ্গেই এক জাতীয় ‘কার্স’ থাকে। কোনও দিক থেকেই যদি চেয়ার টলানো না যায়— তবে কেচ্ছা, কুৎসাই হল ব্রহ্মাস্ত্র! আশ্চর্যের বিষয়, এত কিছুর পরেও রাজনীতিক মানুষটি আদৌ লজ্জিত নন বা বিব্রত নন! আমরা সবাই অনুতপ্ত মুখ দেখার জন্য ‘মারিকিরি-হারিকিরি’ করে উঠে পড়ে লেগেছি। অথচ, প্রেম গাইছে— ‘কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোকে, তাহাতে নাহিক দুখ/ তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার গলায় পরিতে সুখ!’

রাজনীতিবিদ বা কোনও রকম ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মানুষদের জন্য আপাতত ব্রহ্মচর্যের নিয়মাবলি আর সঙ্গে একটি ‘হনুমান চালিসা’ দিয়ে দেওয়াই বোধ হয় ভাল! সব দিক দিয়েই তবে রক্ষে হয়!

সাহিত্যিক (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sovan Chatterjee Baishakhi Banerjee Scandal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE