টি এম কৃষ্ণ।—ছবি পিটিআই
কর্নাটকী সঙ্গীতবিশারদ টি এম কৃষ্ণ অকস্মাৎ জানিতে পারিলেন, রাজধানীর নেহরু পার্কে তাঁহার পূর্বপরিকল্পিত অনুষ্ঠানটি বাতিল হইয়াছে। আয়োজক এয়ারপোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া হঠাৎই দায়িত্ব লইতে পিছাইয়া গিয়াছে, তাই যে অনুষ্ঠান দেখিতে অন্যান্য বৎসর ভিড় ভাঙিয়া পড়ে, এই বৎসর তাহা ঘটিতে পারিবে না। এএআই প্রকাশ্যে বলিল যে আকস্মিক ভাবে একটি অসুবিধার সম্মুখীন হইতে হওয়ায় তাহাদের সিদ্ধান্তটি লইতে হইল। অবশ্যই ইহা কষ্টকৃত অজুহাত। সত্য কথাটি গোপনেই রহিয়া গেল। পরিকল্পিত অনুষ্ঠানে হঠাৎ অসুবিধা আসিয়া পড়া, এবং অনুষ্ঠানকে স্থগিত না করিয়া সোজাসুজি বাতিল করা— সংস্থার মুখ এমন অজুহাতে কোনও ভাবেই উজ্জ্বল হয় না। বাস্তবিক, অজুহাতের দরকারই ছিল না। কেন এই সিদ্ধান্ত, দুয়ে দুয়ে চার করিয়া তাহা বুঝিতে কাহারও ভুল হইবে না। যে কৃষ্ণ নিতান্ত স্পষ্ট ভাষায় প্রতি অনুষ্ঠানে ভারতীয় ঐতিহ্যে সমন্বয়ের আদর্শ তুলিয়া ধরেন, এবং সেই সূত্রে যে কোনও রকমের মৌলবাদ বা অসহিষ্ণুতার চর্চাকে অন্যায় বলেন, এবং সেই সূত্রে ভারতের বর্তমান রাজনীতির কেন্দ্রীয় ধারাটির সমালোচনা করেন, এএআই-এর মতো সরকারি সংস্থা তাঁহার মতো শিল্পীর অনুষ্ঠান অকস্মাৎ বরবাদ করিতে চাহিতে পারে কেন— তাহা বুঝিতে বুদ্ধির বিশেষ সূক্ষ্মতা কেন লাগিবে। বরং ইতিমধ্যে অন্য এক শিল্পী সোনাল মানসিংহের বক্তব্যে ‘কেন’টি স্পষ্টতর হইয়াছে, কারণ তিনি কৃষ্ণের মোদীবিরোধিতা লইয়া ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছেন। ঝুলি হইতে বেড়াল বাহির হইবে, কর্তাব্যক্তিরা হয়তো আশঙ্কা করেন নাই। তাঁহারা নিশ্চয়ই ভাবিয়াছিলেন, অভ্যস্ত নীরবতায় কয়েকটি দিন কাটাইয়া দিতে পারিলেই বিষয়টি লোকে ভুলিয়া যাইবে, এবং টি এম কৃষ্ণ মানে মানে অপমান হজম করিয়া আত্মশুদ্ধির কাজে মন দিবেন।
মুশকিল হইল, কৃষ্ণ অন্য ধাতের মানুষ। কেবল ব্যাকরণ-ভাঙা শিল্পে তিনি বিশ্বাস করেন না, শিল্পের রাজনীতিকে ভাঙিয়া দেখায় বিশ্বাস করেন। মনে করেন, রাজনীতি ও শিল্প এতই ওতপ্রোত যে ইহাদের আলাদা করিয়া বিবেচনা করা যায় না। সুতরাং আত্মশুদ্ধি দূরস্থান, সোনাল মানসিংহকে তিনি প্রভূত ধন্যবাদ দিয়াছেন ভিতরের কথাটি প্রকাশ করিবার জন্য। দ্বিমত ও বহুমতের পরিসর রক্ষা করিবার আদর্শ তাঁহার নিকট কতটা মূল্যবান, একটি সাক্ষাৎকারে তাহা মুক্তকণ্ঠে জানাইয়া দিয়াছেন। বলিয়াছেন, রাজনীতি কথাটি নেতিবাচক হওয়া উচিত নয়। তাঁহার মতে, শিল্প দিয়া শিল্পীরা যাহা করিতে চান, নীতির সূত্রে রাজনীতিও তাহার মধ্যে দৃঢ়প্রোথিত। ‘রাজনৈতিক’-এর মধ্যেই ‘নৈতিক’ আছে, ভুলিয়া গেলে চলিবে না।
যাঁহাদের কৃষ্ণের কথা শোনা দরকার ছিল, তাঁহাদের অবশ্য এই সব শুনিবার বা বুঝিবার ধৈর্য নাই। কিছু বলিবারও দায় নাই। সঙ্কীর্ণতম ও অসহিষ্ণুতম অর্থেই তাঁহারা রাজনীতি শব্দটি বোঝেন। সেই সঙ্কীর্ণ গোত্রে না পড়িলে শাস্তি পাইতে হইবে, ইহা তাঁহাদের কাছে সহজতম ও স্বাভাবিকতম রাজ-নৈতিকতা। গত কয়েক বৎসরে নরেন্দ্র মোদীর সমর্থকরা কত শিল্পীকে এই ভাবে ‘শাস্তি’ দিয়াছেন, সেই হিসাব তাহাদের কাছেও আছে কি? কেহ মুসলিম, কেহ পাকিস্তানি, কেহ বিরুদ্ধবাদী, সুতরাং সরকারি প্রশ্রয়ে গান-নাচ-চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁহাদের প্রবেশ নিষেধ হইয়াছে। ইতিমধ্যে রুপোলি রেখা— আপ দল আশ্বাস দিয়াছে, কৃষ্ণের সাঙ্গীতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হইবে অন্যত্র, রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে। ইহার মধ্যেও রাজনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অভিঘাত স্পষ্ট। সম্ভবত মোদী সরকারের ইহাই সর্বাপেক্ষা গুরুতর অবদান: এই আমল এত দিনে বুঝাইয়া দিয়াছে গণতান্ত্রিক পরিবেশটি বজায় রাখাই আপাতত রাজনীতির প্রথম ও প্রধান লড়াই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy