কোমর-সমান জলে শিক্ষক এবং ছাত্ররা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করিতেছেন। সম্প্রতি অন্তর্জালে তোলপাড় ফেলিয়া দেওয়া ছবিটি এই বৎসরের স্বাধীনতা দিবসের, অসমের একটি স্কুলের। ছবিটিকে লইয়া স্বাভাবিক ভাবেই জাতীয়তাবাদের ধুম পড়িয়াছে। প্রকৃতি মারিলেও দেশপ্রেম যে মরে না, এই ছবি নাকি তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ছবিটি দেখিলে দেশপ্রেমিকের গর্ব হইতে পারে। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের লজ্জা হয় ততোধিক। লজ্জা, কারণ স্বাধীনতার সাত দশক পার করিয়াও স্কুল প্রাঙ্গণে পতাকা তুলিতে শিক্ষক-ছাত্রদের বন্যার জল ঠেলিতে হইতেছে। লজ্জা, কারণ এই চিত্র বিচ্ছিন্ন নহে। প্রায় প্রতি বৎসরই বন্যার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করিতে হয় বিশেষত পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে। এই বৎসর তাহার প্রকোপ হয়তো কিঞ্চিৎ অধিক, কিন্তু তাহা মাত্রার প্রশ্ন।
এহেন ভয়াবহতার দায় কাহার? আপাতদৃষ্টিতে, প্রকৃতির। মৌসুমি বায়ু-নির্ভর ভারতের আবহাওয়া। আর সেই বায়ুর গতিপ্রকৃতিটিই বড় খামখেয়ালি। কোনও বৎসর অনাবৃষ্টিতে দেশ পুড়িয়া মরে, কোনও বৎসর অতিবৃষ্টিতে ভাসে। বর্ষার মরশুমে ভরা নদীনালা অতিবৃষ্টিতে দু’কূল ছাপাইয়া বন্যার সৃষ্টি করিবে— স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই নিতান্ত স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত ঘটনাটির মোকাবিলার মতো পরিকাঠামো এত দিনেও গড়িয়া উঠে নাই। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। ভুক্তভোগীমাত্রেই বন্যারোধে স্থায়ী পরিকল্পনা এবং বাঁধ সংস্কারের আশ্বাস প্রতি বৎসরই শুনিয়া থাকেন। কিন্তু আজও তাহার দেখা মিলিল না। জেলায় বন্যার কারণ হিসাবে বাঁধ হইতে জল ছাড়িবার কথা প্রায়শই শোনা যায়। এ কথা সত্য, প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি ও তৎপরবর্তী ডিভিসি-র জলাধার হইতে ছাড়া জলে সৃষ্ট বন্যার সংখ্যাই এই রাজ্যে বেশি। কিন্তু জলাধার জল ছাড়িলেই পশ্চিমবঙ্গ ভাসিবে কেন? ভাসিবে, কারণ গঙ্গা এবং তাহার শাখাগুলির নদীখাত বলিয়া কিছু নাই, পলি পড়িয়া তাহা প্রায় সমতল। তাই অতিরিক্ত জল নদীবক্ষে পড়িলেই উপচাইয়া যায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে ড্রেজিং ব্যতীত নাব্যতা বৃদ্ধির কোনও স্থায়ী প্রচেষ্টা হয় নাই। সুতরাং দায় শুধু প্রকৃতির নহে। সংশ্লিষ্ট রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারেরও।
দায় আরও আছে। সে দায় সমাজের। নদী, তথা প্রকৃতিকে মান্য করিয়া চলিবার প্রথা আধুনিক সমাজে অন্তর্হিতপ্রায়। পূর্বে নদীর দুই পাড় হইতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখিয়া গড়িয়া উঠিত বসতি। নদী দু’কূল ছাপাইলেও যাহাতে সহসা ঘর ভাসিতে না পারে। পাড়-লাগোয়া জমিতে চলিত কৃষিকাজ। বন্যার পলি পড়িয়া যাহাতে আরও উর্বর হয় মাটি। কিন্তু জনসংখ্যার চাপে সেই দূরত্ব মুছিয়া জনবসতি এখন নদীর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলিতেছে। লক্ষাধিক গৃহহীন হইবার ইহা এক বড় কারণ। অন্য দিকে, নদীকে আটকাইবে যে বাঁধ, তাহার উপরেই চলিতেছে বেআইনি নির্মাণ। সঙ্গে বেআইনি ভাবে মাটি এবং বালি কাটিয়া লইবার ফলেও বাঁধগুলি ক্ষতিগ্রস্ত। জলের তোড়ে বাঁধ ভাঙিয়া পড়িবার তাই এমন বাড়বাড়ন্ত। উপরন্তু নদীপাড়ের বনভূমিও ধ্বংসপ্রায়। মাটি ধরিয়া রাখিবে কে? পরিবেশবিদদের সতর্কতায় কর্ণপাত না করিবার ফল মিলিতেছে। সময় বেশি নাই। এখনই হাল না ধরিলে ধুবুড়ির স্কুলের ছবিটি ভবিতব্য হইয়া উঠিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy