— ফাইল চিত্র।
বাগড়ি বাজারের ঘটনাক্রমকে ‘অভাবনীয়’ বলিলে তাহা নিছকই ভাবিবার অক্ষমতার স্বীকারোক্তি হইয়া যাইবে। এই ধরনের বাড়িতে আগুন লাগিলে তাহার চেহারা কী হইতে পারে, সেই আগুন নির্বাপণ কী পরিমাণ দুরূহ, এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কতখানি বিপুল হওয়া সম্ভব, কোনওটি জানিতেই কল্পনাশক্তির প্রয়োজন ছিল না। কলিকাতা তাহা নিজের অভিজ্ঞতায় জানে। তবু বাণিজ্যের মরসুমে বাগড়ির আগুনে সর্বস্বান্ত হইয়া গেলেন বহু মানুষ। দুর্ঘটনা? না কি, এই পরিণতির অপেক্ষাতেই বসিয়াছিল বাজারটি? গায়ে গায়ে দোকান এবং দাহ্যবস্তুর সারি লইয়া বিনা সতর্কতাতেই দিনাতিপাত করিতেছিল বাগড়ি। সহায় হইয়াছিল প্রশাসনিক ছাড়পত্র। মাত্র দুই মাস পূর্বেই বাগড়ি বাজারকে ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করিয়াছিল কলকাতা পুরসভা। শর্ত ছিল, এক বৎসরের ভিতরে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণের বন্দোবস্ত করিতে হইবে। আশ্চর্য! যে ব্যবস্থা না থাকিলে এক দিনও ব্যবসা করিবার অনুমতি দেওয়া যায় না, সেই অগ্নিসুরক্ষা নিশ্চিত করিবার জন্য পুরসভা এক বৎসর সময় বরাদ্দ করিল। শুধু বাগড়ি নহে, শহরের ৩৭টি বাড়ি এই ভাবেই ছাড় পাইয়াছে। এখন দোষারোপের পালা চলিতেছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দমকল অপটু। স্থানীয়দের অভিমত, দশ বৎসর পূর্বের নন্দরাম বাজারের ঘটনা হইতে শিক্ষা লওয়া উচিত ছিল প্রশাসনের। সরকার বলিতেছে, অগ্নিবিধি মানেন না ব্যবসায়ী এবং স্থানীয়েরা। এই শোরগোলে চাপা পড়িয়াছে প্রকৃত প্রশ্নটি— বাজারের সুরক্ষার দায়িত্ব কাহার?
বাড়িটিতে যাঁহারা ব্যবসা করিতেন, আগুনে তাঁহাদেরই ক্ষতি সর্বাধিক। যুক্তি বলিবে, অগ্নিবিধি মানিবার তাগিদও তাঁহাদেরই সর্বাধিক হওয়া উচিত। কিন্তু, যে হেতু প্রত্যেকে সমপরিমাণে নিয়ম না মানিলে কাহারও একক নিয়মানুবর্তিতায় আগুন ঠেকানো অসম্ভব, এবং যে হেতু প্রত্যেকেই অপরের নিয়ম না মানা বিষয়ে নিশ্চিত, ফলে কেহই নিয়ম মানেন না। ক্ষতির সম্ভাবনা ও পরিমাণ বুঝিয়াও নহে। কিন্তু, প্রশাসন দায় এড়াইবে কোন যুক্তিতে? বাগড়ি বাজার অগ্নিগর্ভ, জানিত পুরসভা ও সরকার। তাহার পরেও এক বৎসরের ছাড়পত্র দেওয়ার কারণ কী? দুর্জনে বলিবে, অসততা। অগ্নিবিধি না মানিলে ঘুষের বন্দোবস্ত আছে, এবং প্রশাসনের কোনও স্তরই সেই সুধায় বঞ্চিত নহে। শুধু বাগড়ি বাজার নহে, সমগ্র নগরটিই কার্যত জতুগৃহে পরিণত হইয়াছে। খাণ্ডবদাহের জন্য সামান্য স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষা। অথচ দায় এড়াইতে ব্যস্ত সরকার। এক মন্ত্রী অন্য মন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলিতেছেন। বাগড়ির ‘ব্যবসা’কে ‘গুন্ডামি’ বলিয়া চিহ্নিত করিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তাঁহার অভিযোগ, ন্যূনতম বিধিপালনেও ব্যবসায়ীদের অনীহা। রবীন্দ্রভক্ত মুখ্যমন্ত্রী হয়তো জানিবেন, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুই পক্ষের জন্যই কবি সমান ঘৃণার সুপারিশ করিয়াছিলেন।
ভ্রম হইতে শিক্ষা লইতে হয়। ভ্রম শুধরাইলে তবেই অগ্রগমন সম্ভব। ইহা জীবনের নিয়ম— সরকারের নহে। তাহারা অগ্নিকাণ্ড হইতে সামান্য শিক্ষাও গ্রহণ করে না। মাত্র দিন কুড়ি পূর্বেই আগুন লাগিয়াছিল এলিয়ট রোডের দেড় শতাধিক বৎসরের পুরাতন এক বাড়িতে। ইহাই দস্তুর। কখনও হাসপাতাল পোড়ে তো কখনও স্টিফেন কোর্ট জ্বলিতে থাকে। কখনও গঙ্গাতীরবর্তী গুদামে আগুন লাগে তো কখনও বস্তির কয়েক শত ঘর ছাই হইয়া যায়। আগুন লাগিবে, কিঞ্চিৎ কোলাহল হইবে, বিরোধীরা সরব হইবেন, নাগরিক সমাজ জাগিয়া উঠিবে। এবং, তাহার পর নূতন বিষয়ের ছাইয়ে সেই পুরাতন আগুন চাপা পড়িবে। অতঃপর পরবর্তী অগ্নিকাণ্ডের অপেক্ষামাত্র। অভিজ্ঞতা হইতে যাঁহারা শিক্ষাগ্রহণ করেন না, দুর্ঘটনার দায় অন্যের ঘাড়ে না চাপাইয়া তাঁহাদের আর উপায় কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy