Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
ভোটের আগে রাম মন্দির নিয়ে এই অসহিষ্ণুতা

সুস্থ রাজনীতি নয়

এটা বেশ পুরনো গল্প। উমা ভারতী তখন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলিকে উমা বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে ভোপালে নিয়ে গিয়েছিলেন এক সরকারি অনুষ্ঠানে।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৮ ০১:১১
Share: Save:

এটা বেশ পুরনো গল্প। উমা ভারতী তখন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলিকে উমা বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে ভোপালে নিয়ে গিয়েছিলেন এক সরকারি অনুষ্ঠানে। রাজনৈতিক জনসভাও ছিল। বিশাল সভা। জন অরণ্য। সুদর্শন পঞ্জাবি ব্রাহ্মণ দীর্ঘ বক্তৃতায় বোঝালেন উন্নয়নের জন্য দিল্লির সরকার কত কাণ্ডই না করছে। তবু হাততালি পড়ল না। বক্তৃতা শেষে উমার পরামর্শে অরুণ কিঞ্চিৎ আরোপিত কণ্ঠে নাটকীয় ভাবে বলে উঠলেন, জয় শ্রীরাম। ব্যস। যেন বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল জনসভায়। সুদীর্ঘ করতালি। উপস্থিত গণদেবতা গর্জে উঠল, ‘জয় শ্রীরাম’। তার পর উমা আমাদের নিয়ে গেলেন এক সরকারি গোশালায়। রাজ্য সরকার গোমাতাদের কত যত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করছে তা দেখানোর জন্য। সেখানে পৌঁছেই উমা ভারতী জড়িয়ে ধরলেন একটি হৃষ্টপুষ্ট গরুকে। খচাখচ ছবি উঠতে লাগল। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ফটো অপরচুনিটি। হঠাৎ উমা বলে উঠলেন, অরুণজি আসুন, গোমাতাকে এক বার স্পর্শ করুন। বেশ কুণ্ঠিত ভঙ্গিতেই অরুণ একটি গরুর গায়ে হাত দিলেন। আবার স্লোগান উঠল: জয় শ্রীরাম। মনে হল, দিল্লির শহুরে অভিজাত আধুনিক অরুণ বোধ হয় জীবনে প্রথম গরু নামক এক গৃহপালিত পশুকে স্পর্শ করলেন। অরুণ কোনও দিনই ঠিক জয় শ্রীরাম টাইপ নেতা ছিলেন না। কিন্তু সে দিন তিনি এটা বুঝতে পারেন যে, উন্নয়নের গালভরা লেকচার যতই দাও না কেন, বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের অ্যাড্রিনালিন নিঃসরণ হয় না। সেটা হয়, যখন প্রসঙ্গ উঠে রাম মন্দিরের।

তাই যখনই দেশে ভোট আসে তখনই বিজেপির রাম মন্দিরের কথা মনে পড়ে যায়। বিজেপির ইস্তাহারে ঘোষিত তিনটি কর্মসূচি: অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। এর আগে বাজপেয়ীর সরকারের না হয় জোটের বাধ্যবাধকতা ছিল, নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির ২৮২ আসন পাওয়া সরকার কেন গত পাঁচ বছরে এই তিনটির কোনওটারই বাস্তবে রূপ দিতে পারল না? বিজেপি-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষদের কথা পরে বলব, আগে তো বিজেপি সমর্থকদের কথা ভাবুন। কেউ কথা রাখেনি, রাখে না— এটা তাঁদের অন্তরের কথা। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে, তাই সরকার এত দিন মন্দির নির্মাণে ব্রতী হতে পারেনি। খুব ভাল কথা। গণতন্ত্রে বিচারবিভাগীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতি মোদী সরকারের কী অচলা ভক্তি! কিন্তু তা হলে ভোটের আগে মন্দির নির্মাণের জন্য অর্ডিন্যান্স করার কথা ওঠে কী করে?

লালকৃষ্ণ আডবাণীর নেতৃত্বে যখন রাম মন্দির আন্দোলন শুরু হয়, তখন বিজেপি, আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটা ছাতার তলায় এসেছিল মন্দির নির্মাণের দাবিতে। সাধু সংসদ হল অনেকটা অসংগঠিত এক নাগরিক সমাজকে ভোটের জন্য সংগঠিত করার চেষ্টা। এখন ভোটের আগে আদালতের তোয়াক্কা না করে যদি অর্ডিন্যান্স নিয়ে আসা হয়, তা হলেও তো সঙ্গে সঙ্গে অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ হয়ে যাবে না। বিজেপি মনে করছে, মন্দির নির্মাণ শুরুর একটা প্রক্রিয়া দেখিয়ে আবার শিলান্যাস হলেই হিন্দি বলয়ে যে সব জায়গায় ‘ম্যাক্সিমাম’ আসন পেয়ে তারা কার্যত সাফল্যের চূড়ায় বসে আছে, সেখানে অন্তত এই ভোটার-ভোলানো মন্ত্র আসন রক্ষায় সাহায্য করবে।

দলের মধ্যে বহু নেতা অবশ্য মনে করছেন, সময় বদলে গিয়েছে। নবীন প্রজন্ম চাকরি চাইছে। শিক্ষার সুযোগ চাইছে। আম জনতা মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষিপ্ত। কলকারখানা বন্ধ, চাষের মাঠে হাহাকার। তাই রাম মন্দির নির্মাণ আজ এক মৃত বিষয়। কোরামিন দিয়ে সেই মরা বিষয়কে বাঁচানোর জন্য ব্যস্ত মোদী-শাহ নেতৃত্ব। এ দেশে, বিশেষত হিন্দি বলয়ে এই অতি প্রাচীন সাবেকি স্লোগান ভোটার সমাজে তীব্র মেরুকরণ সৃষ্টি করবে কি না, সেটা দেখার বিষয়। ২০১৪ সালের ভোটের আগের কথা বলছি। তখন মোদীর টিমের বক্তব্য ছিল, দেশে বিজেপি ২ থেকে যে প্রায় ২০০ হয়েছিল, তা হয়েছিল রাম মন্দির আন্দোলনের জন্য। এর পর জোট যুগের বাধ্যবাধকতা থেকে আডবাণীর জিন্না বিতর্ক— বিজেপির রাজনীতির আরোহণ থেকে অবরোহণের বৃত্ত। ২০১৪ সালে হিন্দুত্বের সঙ্গে শক্তিশালী রাষ্ট্রভাবনাকে যুক্ত করে এক কড়াপাক সুস্বাদু সন্দেশ তৈরি করেন মোদী। গোটা পৃথিবী জুড়ে আবার কুসংস্কার আর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাবল্য ফিরে আসছে। তীব্র আর্থিক সঙ্কট, দারিদ্র, কর্মহীনতা— এ সবই হয়তো এই ধর্মীয় ও জাতিগত উন্মাদনা বৃদ্ধির কারণ। অক্সফোর্ডের কিছু অধ্যাপক গবেষণা করে ২০১৪ সালে ঘোষণা করেন, ‘দ্য গড ইজ় ব্যাক’। তাই ভারতেও হিন্দুত্বের নতুন প্যাকেজ, যাকে বলা হয়েছিল মোদীত্ব, সেই রেসিপি বিজেপিকে বিপুল সাফল্য দেয়। মোদী ২০১৯ সালে সেই উগ্র হিন্দুত্বর পথ থেকে সরতে চান না। পাঁচ বছরে মোদীর সরকারের নানা ব্যর্থতা বিশেষত আর্থিক ক্ষেত্রের ল্যাজেগোবরে অবস্থা মোদীর জনপ্রিয়তায় অনেকটাই চিড় ধরিয়েছে। আবার পুরনো রাহুলের বদলে আজ আমরা এক নতুন অতিসক্রিয় রাহুলকে দেখছি, বিজেপি নেতারাও সে কথা মানছেন। তবে মোদীর জনপ্রিয়তা সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়েছে, এমনটাও কিন্তু ঠিক নয়।

আমাদের দুর্ভাগ্য, ভারতের কতিপয় বাম-উদারবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হিন্দুধর্মকেই প্রায় কুসংস্কার ও পরিত্যাজ্য বলে প্রচার করতে চেয়েছেন। সেই কোন সুদূর অতীত থেকে। রাহুল গাঁধী মন্দিরে গেলে কমিউনিস্টদের গোসা হয়, অথচ মসজিদে গিয়ে ইমামদের সঙ্গে বৈঠকে তাঁদের ধর্মনিরপেক্ষ কৌলীন্য বাড়ে। দেরিতে হলেও, তাঁদেরও অনেকে বুঝতে পারছেন, এ দেশে সমাজতন্ত্রী নাস্তিকতার স্টিমরোলার চালাতে গিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ব নামক হিন্দুধর্মের সঙ্কীর্ণ বিকৃতির শ্রীবৃদ্ধি হয়।

আবার বিজেপি সেই জনপ্রিয় কুসংস্কার এবং মানুষের ভুল আবেগে তাড়িত অগ্রাধিকারকে সুড়সুড়ি দিয়ে বাজিমাত করতে চাইছে। তারা সফল হবে কি না জানি না, কিন্তু এই পশ্চাদ্‌মুখিতার জন্য আমাদের খুশি হয়ে জয়ধ্বনি দিতে হবে?

সেই কোন শৈশব থেকে শুনছি অযোধ্যায় রাম জন্মেছিলেন। কিন্তু বাবরি মসজিদের জমিতেই যে রামজন্মভূমি, সেটা জানলাম ১৯৮৯ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্দোলনের সময়। ১৯৯০ সালে আডবাণীর রথযাত্রা। ’৯১ সালে উত্তরপ্রদেশ বিজয়। তার পর ৬ ডিসেম্বরের কালো দিন। নরসিংহ রাও সেই যে বিষয়টিকে সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়েছেন, প্রধান বিচারপতি বেঙ্কটচালাইয়া থেকে বর্তমানের রঞ্জন গগৈ— শীর্ষ আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। তবু এত দিন নিশ্চুপ থাকার পরে আজ যখন সুপ্রিম কোর্ট জানুয়ারি মাসে শুনানির দিন ক্ষণ জানাবে বলছে, তখন আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ভোটের আগে অর্ডিন্যান্সের অসহিষ্ণুতা, আর যা-ই হোক, সুস্থ রাজনীতি নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Law Ram Mandir Supreme Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE