নিশানা: এয়ারসেল-ম্যাক্সিস সংক্রান্ত তদন্তের সূত্রে সিবিআই দফতরের পথে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। দিল্লি, জুন ২০১৮
দিল্লির পথে পথে ইতিহাস ছড়ানো। প্রতি দিন বাড়ি থেকে অফিস যাই জানা-অজানা নানা মুঘল স্থাপত্য দেখতে দেখতে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্মৃতি তো আছেই। মুঘল আমলে এই তো সেই দিল্লি ছিল, যা ছিল ষড়যন্ত্রনগরী। মুঘল সম্রাটদের অন্দরমহলে শুধু তো সম্রাট নন, প্রতি মুহূর্তে সেই বিবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন মন্ত্রী, সেনাপতি অজস্র পাত্র-অমাত্য খোজা-প্রহরী, ভৃত্য, রূপসি পরিচারিকা পর্যন্ত। নবাবের উত্তরাধিকার নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট আইন সে দিন ছিল না। ভাই ভাইকে হত্যা করেছে। পুত্র বাবাকে। বাবা পুত্রকে হত্যা করেছে। দেওয়ালের কান তো থাকেই। এক জন আর এক জনকে এসে গোপন খবর জানিয়ে যায়। আর তার ভিত্তিতে রচনা হত ষড়যন্ত্রের নকশা।
এই ২০১৮ সালে রাজধানীর ক্ষমতার অলিন্দে পদচারণা করতে করতে মনে হয়, সেই ষড়যন্ত্র আজও রাজধানীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই চার বছরে বার বার মনে হয়েছে শাসক দল ও সরকার বেশি ব্যস্ত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে। মুঘল আমলে প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড হত। দারাকে হত্যা করে আওরঙ্গজেব তাঁর মস্তকটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পিতা শাহজাহানের কাছে। গণতন্ত্রে আজ সেই প্রকাশ্য হত্যা নেই, কিন্তু সকলের অজান্তে রক্তপাত হয়। হত্যাও হয়। হিংসা তো শরীরের নয়, মনেরও হয়।
রজনীকান্তকে ফরমান দেওয়া হল, আপনি বিজেপিতে যোগ দিন। তিনি রাজি হলেন না। পরের দিন অর্থমন্ত্রকের অধীনস্থ এনফোর্সমেন্ট দফতর তাঁর স্ত্রী-র বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে পড়ল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে রজনীকান্তের স্ত্রী-কে গ্রেফতার করা হলেও বিস্মিত হব না। একেই বলে প্রতিহিংসার রাজনীতি। দেশের উন্নয়ন আর সাধারণ মানুষের দুর্গতিমোচনের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে বদলার রাজনীতি। ভোটে জেতার জন্য প্রয়োজনে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।
আপনি পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, মুঘল আমলের পর মোদীই কি প্রথম ভারত-সম্রাট যিনি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করছেন? এ তো চিরকালীন। দলমত নির্বিশেষে চিরকালই হয়েছে। এর জবাবে বলব, আমিও মনে করি এই প্রতিহিংসার রাজনীতি, এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ভারতে এই প্রথম নয়। মনে হয়, ইন্দিরা গাঁধীর সময়েই প্রথম ভারতীয় রাজনীতির মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়। অনেকে ইন্দিরা যুগকে তাই বলেন, ‘এন্ড অব ইনোসেন্স’। নরসিংহ রাওয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, হাওয়ালা কেলেঙ্কারিকে মূলধন করে শুধু লালকৃষ্ণ আডবাণী নন, মাধব রাও সিন্ধিয়া-অর্জুন সিংহের মতো নেতাদের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিহিংসার তাস ব্যবহার করেছেন। আবার, নর্থ ব্লকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দফতরের আসবাবপত্রে চুইংগামের মতো কিছু চটচটে পদার্থ পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, এগুলি গোপনে খবর সংগ্রহের প্রযুক্তি। সে সময়ে প্রণববাবু ও সতীর্থ মন্ত্রী চিদম্বরমের ছায়াযুদ্ধ আজ সুবিদিত।
তবু বলব, মোদীর জমানায় যে প্রতিহিংসার রাজনীতি দেখলাম তা অতুলনীয়। বিভাজনের কৌশল, বিদ্বেষের মেরুকরণ, প্রতিহিংসার রাজনীতি, সিবিআই বা এনফোর্সমেন্ট শাখাকে
দিয়ে ভয় দেখানো, ব্ল্যাকমেল করা, ক্ষুদ্র রাজনীতিকে অভীষ্ট মেনে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে মতাদর্শের রাজনীতি ভুলে যাওয়া। আর এই রাজনীতির সাফল্যের পাসওয়ার্ড একটাই: ‘অর্থ’। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষায়— টাকার টঙ্কারে শুনি, মায়া এ পৃথিবী।
চিদম্বরমের পুত্রের বিরুদ্ধে শুধু তদন্তই নয়, তদন্তকারী অফিসারেরা তাঁর বাবার সঙ্গে যে ভাবে অভব্য ব্যবহার করছেন, যে ভাবে সুষমা স্বরাজের বিরুদ্ধে মোদীভক্তরাই টুইটারের মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন, সে সব দেখে মুঘল আমলের গোপন ষড়যন্ত্রের রাজনীতিই মনে পড়ছে। উগ্র হিন্দুয়ানার প্রচার আর সুষমাকে হিন্দুত্ববিরোধী প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় দেশের মানুষের কোন স্বার্থ জড়িয়ে আছে বলতে পারেন?
গত চার বছরে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে মার্গদর্শকমণ্ডলীর সদস্য করে তাঁকে সম্পূর্ণ অপাঙ্ক্তেয় করে রাখা হল। এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সর্বশেষ উদাহরণ অরুণ জেটলিকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো। সুষমা স্বরাজের কিডনি প্রতিস্থাপনের সময়ে তাঁকে বিদেশমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয়নি। তা হলে অরুণ জেটলির ক্ষেত্রে তাঁকে দফতরহীন মন্ত্রী করে পীযূষ গয়ালকে অর্থমন্ত্রী করা হল কেন?
দিল্লিতে যে সব দেওয়ালের কান আছে, সে সব দেওয়ালই বলছে, ভোটের আগে কোনও শিল্পগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার্থে মুম্বইবাসী পীযূষ গয়ালকে অর্থমন্ত্রী করা হয়েছে। আর্থিক সংস্কার, জিএসটি, এমনকি বাজেট তৈরি করার সঙ্গে অরুণ জেটলিকে সরানোর কি কোনও সম্পর্ক আছে? না কি, সৎ বলে পরিচিত অরুণ জেটলির ভাবমূর্তি আমজনতার সামনে উজ্জ্বল, তাই সুচতুর ভাবে স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। এ ঘটনা যদি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র না-হয় তবে ষড়যন্ত্র কাকে বলে?
বলতে পারেন আজকের রাজনীতিটাই এ ধরনের বদলা নেওয়ার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। গোধরা কাণ্ডের পর এবং গুজরাতে নানান এনকাউন্টারের ঘটনার সিবিআই তদন্ত, কংগ্রেসও অতীতে মোদীকে নানা ভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু সেই সিবিআই, যাকে মোদী নাম দিয়েছিলেন কংগ্রেস ব্যুরো অব ইন্ডিয়া, তাকেই ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে বধ করার ওই কৌশলকে কি উচিত রাজনীতি বলতে হবে? সিবিআই প্রধান অলোক বর্মার সঙ্গে গুজরাত ক্যাডারের অফিসার সিবিআইয়ের দ্বিতীয় ব্যক্তি রাকেশ আস্থানার যে অভ্যন্তরীণ কলহ শুরু হয়েছে, সেটাও বলা হচ্ছে, মূলত প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ভাবনাটা হল: বর্মা অবসর নিলে মোদী-ঘনিষ্ঠ আস্থানা সিবিআই প্রধান হবেন। কিন্তু বিদায়কালে বর্মা বেঁকে বসেছেন এবং রাজনৈতিক কারণে কোনও তদন্ত করতেও রাজি হচ্ছেন না। আস্থানা নিজে থেকে তদন্ত করতে চলে যাচ্ছেন দেখে বর্মা চিঠি দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে তদন্তের ব্যাপারে আস্থানা তাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি নন।
গোয়েন্দা কর্তারা এখন অতিসক্রিয়। কে কী করছেন সব জানতে হয় তাঁদের। পাকিস্তান কী করছে শুধু সেটা জানলে তো হয় না। রাজনাথ সিংহের ছেলে অথবা তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীর মেয়ে সংসদ সদস্য হয়ে দিল্লিতে কার কার সঙ্গে দেখা করছেন— এ সবও জানতে হয়। আবার বলছি অতীতে এ সব হয়নি তা নয়। প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তারা তো অনেকে বই লিখে সে সব কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তফাত একটাই। সেটা হল অগ্রাধিকারের। দিল্লি চিরকালের ষড়যন্ত্রনগরী। কিন্তু রাজ্যপাট ভুলে শুধু ষড়যন্ত্র আর টাকা দিয়ে কৌশল রচনার রাজনীতি এ ভাবে দেখিনি গত ত্রিশ বছরে।
বিক্ষুব্ধ শিবসেনাকে ম্যানেজ করো, কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামীর সঙ্গে লড়িয়ে দাও কংগ্রেসকে, কাশ্মীরে পিডিপি-কে ভেঙে দাও। এক প্রবীণ সাংবাদিক অনেক দিন আগে আমাকে বলেছিলেন, অতীতে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা সহজ ছিল। কারণ সেটা শুধু রাজনীতির ভিত্তিতেই হত। এখন তো টাকা নামক আর এক শর্ত যুক্ত হয়েছে রাজনীতিতে। তাই বিশ্লেষণে ভুল হয়ে যায়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও গৃহীত হচ্ছে টাকার প্রেক্ষিতে। যাকে আমরা বলি ‘ডিল’। ষড়যন্ত্র আর ডিলের এই রাজনীতিকে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy