প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা দুর্বল হইলে স্কুলশিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকিবার ঝুঁকি অধিক। শিক্ষা বিষয়ক একটি জাতীয় সমীক্ষা (‘অসর’ ২০২০) তাহা দেখাইল। ভারতে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যত উপেক্ষিত। ফলে বহু বৎসরের প্রচেষ্টায়, বহু অর্থব্যয়ে একশো শতাংশ শিশুকে বিদ্যালয়ে আনিয়াও প্রকৃত হিসাবে শিক্ষাবঞ্চনা কমে নাই। অনেক শিশু ক্রমাগত পিছাইয়া পড়ে, অবশেষে স্কুল ছাড়িয়া দেয়। কারণ, গোড়ায় গলদ। প্রথাগত স্কুলে ভর্তি হইবার পূর্বে এক-দুই বৎসর শিশুর প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশে সেই দায়িত্ব প্রধানত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের। ভারতে পাঁচ বৎসর বয়সি শিশুদের সত্তর শতাংশ অঙ্গনওয়াড়িতে নাম লিখাইয়াছে। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে প্রধানত ‘খিচুড়ি ইস্কুল’ করিয়া রাখিয়াছে। অপুষ্টির মোকাবিলা তাহার প্রধান কাজ, অশিক্ষার নহে। খেলার মাধ্যমে শিশুর যে সকল দক্ষতা বিকশিত হইবার কথা, তাহা হইতেছে না। ফলে অঙ্গনওয়াড়িতে দুই বৎসর কাটাইবার পরেও প্রাথমিক স্কুলে প্রবেশ করিয়া শিশুরা পিছাইয়া পড়ে। বয়স বাড়িবার সঙ্গে লিখিবার-পড়িবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ঠিকই, কিন্তু শ্রেণি অনুসারে প্রত্যাশিত ক্ষমতা তৈরি হয় না। ‘প্রথম’ সংস্থার এই সমীক্ষা ফের মনে করাইল, সকল শিশুকে শিক্ষার সমান লাভ দিতে হইলে চার বৎসর হইতে আট বৎসর বয়সি শিশুদের পাঠদানে ধারাবাহিকতা বজায় রাখিতে হইবে।
তাহার জন্য সরকার কী করিতেছে? প্রথম উদ্বেগ, যে বয়সে যে শিক্ষা প্রয়োজন, বহু শিশু আজও তাহা হইতে বঞ্চিত। বাঁকুড়ায় সমীক্ষকেরা দেখিয়াছেন, চার ও পাঁচ বৎসরের শিশুদের প্রায় পাঁচ শতাংশ অঙ্গনওয়াড়ি বা স্কুলে ভর্তি হয় নাই, ছয় বৎসরের শিশুদের প্রায় অর্ধেক ভর্তি হইয়াছে প্রাক্-প্রাথমিকে। দ্বিতীয়ত, প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রাথমিক স্কুলগুলিতে একটি বাড়তি শ্রেণি চালু করিয়াছে সরকার। আক্ষেপের বিষয়, এ রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলে ওই শিশুদের জন্য আলাদা শিক্ষক নাই, কক্ষও নাই। এই অবহেলার জন্য বাঁকুড়ার মতো দরিদ্র জেলাতেও পঞ্চমবর্ষীয় শিশুদের চল্লিশ শতাংশ পড়িতেছে বেসরকারি স্কুলে। সমীক্ষায় প্রকাশ, ‘কেজি’ স্কুলের পড়ুয়াদের তুলনায় অঙ্গনওয়াড়ি পড়ুয়ারা পিছাইয়া আছে সকল রাজ্যেই। অপর দিকে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে পঠন-পাঠন কেমন হইতেছে, তাহার খোঁজ সম্ভবত সরকারও রাখে না। তাহার একটি দৃষ্টান্ত নীতি-আয়োগের একটি মূল্যায়ন (২০১৫)। শিশুদের নাম লিখাইবার হার, তাহাদের ওজন এবং স্বাস্থ্যপরীক্ষার তথ্যের নথিভুক্তি, ঘরগুলির পরিকাঠামো, সবই দেখিয়াছিল আয়োগের সমীক্ষা। তবে শিক্ষা বিবেচিত হয় নাই। এই মনোভাব ব্যতিক্রম নহে। বিভিন্ন সময়ে হওয়া বিভিন্ন সমীক্ষায় ধরা পড়িয়াছে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের বহু শিক্ষিকার প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণির উপযোগী পাঠদানের প্রশিক্ষণ নাই, প্রয়োজনীয় শিক্ষণ-সরঞ্জাম নেই, ইচ্ছাও নাই। তাহার ফল যেমন হওয়ার কথা, তেমনই হইতেছে।
ইহার ফলে ভারত তাহার মানবসম্পদের একটি মস্ত অংশ হারাইতেছে। শিক্ষার অধিকার আইন কার্যকর করিয়াও সকল শিশু স্কুল সম্পূর্ণ করিতে পারে না, কারণ স্কুলে থাকিয়াও সে শিক্ষা-বঞ্চিত থাকিয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে তেত্রিশ শতাংশ পড়ুয়া স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ করে না, তামিলনাড়ুতে এগারো শতাংশ। তাহার অন্যতম কারণ, তামিলনাড়ুর অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি অধিক সক্রিয়, পাঠদানে নিবিষ্ট। প্রশাসনকে বুঝিতে হইবে, ‘শিক্ষার অধিকার’ কেবল স্কুলে বসিয়া থাকিবার অধিকার নহে। শ্রেণির পাঠ ছাত্র যাহাতে গ্রহণ করিতে পারে, তাহার জন্য শিশুর লিখিবার, পড়িবার, অঙ্ক কষিবার বুনিয়াদি ক্ষমতা গড়িয়া দিতে হইবে। সেই দৃষ্টিতে দুই বৎসরের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব কম নহে। তাহাকে ‘এলেবেলে’ ভাবিবার অভ্যাস ছাড়িতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy