দীর্ঘ সময় অধ্যাপনার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার ঠিক আগে, সুকুমার সেন মন্তব্য করেছিলেন, “যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বিদ্যা সঞ্চয় করেছিলুম, সাধ্য মত বিদ্যা বিতরণ করেছিলুম, সে বিশ্ববিদ্যালয় আজ আমার কাছে শুধু নিষ্প্রাণ না, ভূতগ্রস্ত। এ কথাগুলি লিখতে আমার কষ্ট হচ্ছে।’’ (দিনের পরে দিন যে গেল, পৃ. ৩৩৫)
যাঁরা প্রেসিডেন্সি কলেজে কোনও এক সময় পড়েছেন বা পড়িয়েছেন, তাঁরা অনেকেই এই উক্তির তাৎপর্য বুঝতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। প্রশ্ন হল, এই অবস্থায় কী করে পৌঁছল এক স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান! আমি কিছু প্রশাসনিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। গত তিন বছর ধরে আমি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের প্রতিনিধি (চ্যান্সেলর’স নমিনি) হিসাবে অনেকগুলো শিক্ষক নির্বাচন কমিটির মিটিংয়ে যোগ দিয়েছি। আচার্যের প্রতিনিধি হিসেবে কিছু কাজ করতে পারব জেনে খুশি হই কারণ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজে শিক্ষা লাভ করেছি, উচ্চশিক্ষার হাতে-খড়ি এখানেই হয়েছে। গত চার দশক ধরে যে অধ্যাপনা করতে পেরেছি তার জন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কখনও ভুলতে পারব না।
প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক নির্বাচনের সভা প্রথম থেকেই আমাকে অবাক করেছে। প্রথম বার লক্ষ করলাম এক জন অধ্যাপক নির্বাচনের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের তিন জন বিশেষজ্ঞ। নিয়ম অনুসারে সর্বসাকুল্যে তিন জন বিশেষজ্ঞকেই আমন্ত্রণ জানানো যায়, সুতরাং এতে আইনগত কোন বাধা নেই, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা বিরল। এত বড় দেশ, এত বিশ্ববিদ্যালয়, তবু একই স্থান থেকে তিন-তিন জন বিশেষজ্ঞ! কিছু বলব ভেবেছিলাম কিন্তু আমায় কিছু করতে হল না। ব্যাপারটা এতই দৃষ্টিকটু যে তিন জনের এক জন বলে বসলেন, এটা তো এক ধরনের অজাচার (ইনসেস্ট), কী ভাবে আপনারা একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন জনকে আনলেন? তাঁর প্রশ্নে কোনও লাভ অবশ্য হল না।
দ্বিতীয় বারেও একই অভিজ্ঞতা। এ বারে সব কিছু একটু ভাল করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নির্বাচন সভায় উপাচার্য উপস্থিত থাকেন না। তাঁর এক প্রতিনিধি সভাপতিত্ব করেন। এ ধরনের ব্যবস্থা ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। কিন্তু সেখানকার কাঠামো আলাদা, উপাচার্যর অনুপস্থিতি কোনও সমস্যা সৃষ্টি করে না। কিন্তু আমাদের দেশে উপাচার্যই প্রধান কর্ণধার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে স্যর আশুতোষ প্রায় তিন দশক ধরে অধ্যাপক নিয়োগে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। জগদীশচন্দ্র বসু, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে মরাঠি ইতিহাসবিদ ডি ডি কোসাম্বি এবং আরও অনেক নামী অধ্যাপককে ভারতের নানা জায়গা থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন তিনি। বিশ্বখ্যাত দু’জন সমাজবিজ্ঞানী, এম এন শ্রীনিবাস এবং আন্দ্রে বেতেইকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ভি কে আর ভি রাও সেখানে নিযুক্ত করেন। রাওই অমর্ত্য সেন, জগদীশ ভগবতী, সুখময় চক্রবর্তীকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে নিয়ে আসেন। আর প্রেসিডেন্সিতে কিনা সেই উপাচার্যই অনুপস্থিত।
আচার্যের প্রতিনিধি হয়ে আরও কয়েক বার প্রেসিডেন্সি গিয়েছি এবং লিখিত ভাবে মতামত ব্যক্ত করেছি। আশা করি ভবিষ্যতে ভাল কিছু হবে।
এ বার শিক্ষা সংক্রান্ত একটা প্রসঙ্গ। যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য নির্ভর করে শিক্ষকদের তৈরি পাঠ্যক্রমের উপর। এটা ছাত্রদের কাছে বাইবেল এর মতো। দীর্ঘদিন সমাজ বিজ্ঞান অধ্যাপনা করে এসেছি বলে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই। ইস্কুলের চৌকাঠ পেরিয়েই ছাত্রদের পড়তে হয় কঠিন কিছু পাঠ্যপুস্তক এবং নানা বিষয় যেমন জিনিয়লজিস অব দ্য সোশ্যাল (অর্থ খুঁজে পাওয়া মুশকিল) অথবা ক্রিটিকাল স্কুল অব সোশিয়োলজি। বিএ অনার্স কোর্সে পড়তে হয় খুবই জটিল কিছু বই, যেমন সিমেল-এর ফিলসফি অব মানি, লেভি স্ত্রস-এর সেভেজ মাইন্ড, কিংবা মিশেল ফুকো-র টেকনোলজি অব দ্য সেল্ফ। পৃথিবীর খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে পাঠ্যক্রমে এই সব বই দেখা যায়। দ্বিতীয় সিমেস্টারে পড়তে হয়ে একটি কোর্স, যার শিরোনাম ‘লাভ’। সমাজবিদ্যার সাধারণ জ্ঞান ছাড়া কী করে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের এই ধরনের কোর্স পড়ানো সম্ভব, তা আমার জানা নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের কথা মনে রেখে পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয় না। এর মূল্য এখন তাদের দিতে হচ্ছে। ইউজিসি পাঠ্যক্রম কেন্দ্রীয়করণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর অর্থ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম একই রকম হবে। এটাও যে খুব ভাল প্রস্তাব, তা আমি মনে করি না।
আরও একটা বিষয়ে বলি। প্রেসিডেন্সির বর্তমান প্রশাসনের ধারণা, ক্লাসরুমই জ্ঞান অর্জনের একমাত্র স্থান। শিক্ষকদের লেকচার ছাত্রদের কাছে বেদবাক্যের মতো পৌঁছে গেলেই হল! তাই আস্তে আস্তে ছাত্রছাত্রীদের পুরনো ক্যান্টিন, পোর্টিকোর নীচে ছোট বসবার জায়গাগুলি ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে। এগুলিও শিক্ষা অর্জনের মূল্যবান স্থান। এইখানেই তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা অনেক কিছু জানার ও শেখার সুযোগ পায়। এগুলো হারিয়ে গেলে যে মস্ত বড় ক্ষতি হবে, সে কথা প্রশাসনকে বোঝাবে কে! দরকার অত্যাধুনিক লাইব্রেরিও। লাইব্রেরির যা পরিকাঠামো দেখলাম, তা আধুনিক বললেও বাড়িয়ে বলা হবে।
গত বছর প্রেসিডেন্সি দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর্থিক অনুদান দিতে কার্পণ্য করেননি। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকা মঞ্জুর করা হয়। ঝকঝকে বিল্ডিং দেখে বোঝা যায় আর্থিক সচ্ছলতা। আশা করেছিলাম কোনও প্রকাশনার মাধ্যমে দু’শো বছরের ইতিহাস জানা যাবে। যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হয়েছিল হানড্রেড ইয়ার্স অব দি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটা। কী মূল্যবান গ্রন্থ, ৫৩৯ পাতা ভর্তি নানা ধরনের অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য, অসাধারণ কিছু ছবি, সুন্দর ঝরঝরে লেখা। নীহাররঞ্জন রায়, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, প্রমথনাথ ব্যানার্জি এবং আরও অনেকের গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ পায় এই গ্রন্থে। দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রেসিডেন্সি থেকে পেলাম, ২৩৯ পাতার আ মেজার অব ইনফিনিটি। চকচকে কাগজে ছাপানো, দুই-তৃতীয়াংশ ছবিতে ভরা, বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-অধ্যাপিকার ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের অন্যান্য দ্রষ্টব্য বস্তুর। কোনও প্রবন্ধ চোখে পড়ল না যা থেকে দ্বিশতবার্ষিকীর তাৎপর্য বোঝা যেতে পারে। দু’শো বছরের ইতিহাস কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
সারা দেশে উচ্চশিক্ষা চলেছে জটিল সমস্যার মধ্যে দিয়ে। তারই মধ্যে প্রেসিডেন্সির সমস্যা জটিল থেকে ক্রমশ জটিলতর হয়ে উঠছে। আশা করি প্রেসিডেন্সি ভবিষ্যতে এই অবস্থা থেকে মুক্তির একটা রাস্তা খুঁজে নেবে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy