Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
দরজা, জানালা খুলে ঘরে কীটনাশক ঢোকার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। লিখছেন স্বপনকুমার মণ্ডল

জনচেতনার উপরেই নির্ভর করছে ডেঙ্গি প্রতিরোধ

ইডিস মশা দমনে সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা হল, মশাকে জন্মাতে না দেওয়া বা আঁতুড়ঘরে মেরে ফেলা। ঘরে জমানো জল সপ্তাহে একবার করে ফেলে দিতে হবে এবং সম্ভব হলে পাত্রটিকে ঘষে মাজতে হবে।

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৮ ০২:৩৬
Share: Save:

প্রথমে আসা যাক, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে। এই মশা যেহেতু দিনের বেলা কামড়ায়, রাত্রে মশারি টাঙ্গিয়ে ডেঙ্গি ঠেকান যাবে না। তবে শিশু, ডেঙ্গি আক্রান্ত, অসুস্থ, বয়স্ক, দিনের বেলা ঘুমান এমন ব্যক্তিরা অবশ্যই মশারি ব্যবহার করবেন। মশারি ও পর্দা কীটনাশক মিশ্রিত হলে ভাল। ঘরে মোটা কাপড়ের তৈরি ঢোলা ফুলপ্যান্ট, পুরো-হাতা জামা, মোজা ও জুতো পরে থাকতে হবে। শরীরের খোলা অংশে ও পোশাকে ইউক্যালিপটাস বা সিট্রোনেলা তেল, বা খোলা অংশে মশা তাড়ানোর মলম মাখা যায়। নিমপাতা বা ধুনোর ধোঁয়া মশা তাড়ানোয় কার্যকরী। এ ছাড়া, মশা তাড়ানোর কয়েল, ম্যাট বা তেল (লিকুইড ভেপারাইজার) তো আছেই। দরজা-জানালায় মিহি নেট বসিয়েও ঘরে মশা ঢোকা বন্ধ করা যায়।

বিশেষজ্ঞেরা সকলেই একমত যে, ইডিস মশা দমনে সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা হল, মশাকে জন্মাতে না দেওয়া বা আঁতুড়ঘরে মেরে ফেলা। ঘরে জমানো জল সপ্তাহে একবার করে ফেলে দিতে হবে এবং সম্ভব হলে পাত্রটিকে ঘষে মাজতে হবে। জলের ট্যাঙ্ক, চৌবাচ্চা, বালতি, ড্রাম প্রভৃতির ঢাকনা ভাল ভাবে বন্ধ রাখতে হবে অথবা নেট দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ভাঙাচোরা পাত্র, টব, বাতিল টায়ার, প্লাস্টিক ও থার্মোকলের থালা, কাপ, বাটি, আবর্জনা বাইরে জমিয়ে রাখা যাবে না। ফাঁকা টব, পাত্র উপুড় করে রাখতে হবে, যেন জল না জমে। বাড়ির ছাদ, আশেপাশে, নির্মাণস্থলে জল জমতে দেওয়া যাবে না। গাছের কোটর, পত্র-মূল, বাঁশের খুঁটির গর্ত বর্ষার আগে মাটি বা বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আবর্জনা, আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। তা হলেই ইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সঙ্গে ডেঙ্গিও।

এবার আসা যাক লার্ভা দমনের বিষয়ে। রাসায়নিক কীটনাশক টেমেফস (৫০ ইসি) বা ইন্সেক্ট গ্রোথ রেগুলেটর— ডাইফ্লুবেঞ্জুরন (২৫ ডব্লিউপি ২ জিটিবি) বা পাইরিপ্রক্সিফেন (০৫ জি) লার্ভা দমনে খুবই কার্যকরী। এ কাজে খনিজ তেল ব্যবহার করা যায় নির্দিষ্ট মাত্রায়। লার্ভা দমনে ব্যাকটেরিয়া (ব্যাসিলাস থুরিঞ্জিয়েন্সিস ইস্রায়েলেন্সিস) ঘটিত কীটনাশকের (৫ ডব্লিউপি ১২ এএস) ব্যবহার শুরু হয়েছে বেশ আগেই, বাজারে পাওয়াও যাচ্ছে নানা ব্র্যান্ড। ব্যবহারের আগে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডটির গুণমান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

মশার লার্ভা দমনে পরভোজী মাছের ব্যবহার আছে। গাপ্পি ও গাম্বুসিয়া ছাড়াও কিছু দেশিয় মাছ মশার লার্ভা খায়। বর্তমানে ইডিস মশার লার্ভা দমনে বিভিন্ন পৌর এলাকার জলাশয়ে গাপ্পি মাছ ছাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোন আবাসন বা পার্কের কৃত্রিম ছোট জলাধার বা অকেজো ফোয়ারায় মাছ ছাড়া হলে তা নিশ্চয়ই ইডিস দমনে সহায়ক হবে। কিন্তু ইডিস মশা যেহেতু বড় জলাশয়ে বংশবিস্তার করে না, তাই সেখানে মাছ ছেড়ে সত্যিই কোনও লাভ হবে কিনা, ভেবে দেখা দরকার।

পূর্ণাঙ্গ মশা মারার কাজে ঘরের মধ্যে কীটনাশকের রেসিডুয়াল স্প্রে বা স্পেস স্প্রে (কোল্ড ফগিং বা আলট্রা লো ভলিউম স্প্রে), বাইরে স্প্রে বা ফগিং (কোল্ড বা থার্মাল ফগিং) করা যায়। ইডিস ইজিপ্টাই যেহেতু ঘরের ভিতরে থাকে, রেসিডুয়াল স্প্রে বা স্পেস স্প্রে বেশি কার্যকরী হবে। বাইরে স্প্রে বা ফগিং অ্যালবোপিক্টাস এবং ক্ষেত্র-বিশেষে ইজিপ্টাই দমনে কাজে লাগান যায়। ডেঙ্গি সংক্রমণের উপকেন্দ্রটিকে চিহ্নিত করে তার এক থেকে দেড় কিমি ব্যাসার্ধের এলাকায় ফগিং করা উচিত। এই সময়ে দরজা-জানালা খুলে রেখে ঘরে কীটনাশক যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।

ঘরের ভিতরে স্পেস স্প্রে হিসাবে পাইরেথ্রাম (২ ইসি), সাইফেনোথ্রিন (৫ ইসি) অথবা ডেল্টামেথ্রিন (১.২৫ ইউএলভি) ব্যবহৃত হয়। রেসিডুয়াল স্প্রের জন্য ডিডিটি (৫০ ডব্লিউপি) ম্যালাথিয়ন (২৫ ডব্লিউপি), ডেল্টামেথ্রিন (২৫ ডব্লিউপি), সাইফ্লুথ্রিন (১০ ডব্লিউপি), ল্যাম্বডা-সাইহ্যালোথ্রিন (১০ ডব্লিউপি.),আলফা-সাইপারমেথ্রিন (৫ ডব্লিউপি), বাইফেনথ্রিন (১০ ডব্লিউপি) ব্যবহার করা যায়। বাড়ির চারপাশের ছোট গাছ, ফেন্সিং, পার্কের ছোট গাছে বা ঝোপঝাড়ে কীটনাশক স্প্রে করা যায়। বাইরে ফগিং-এর জন্য ব্যবহৃত কীটনশাকগুলি হল— ম্যালাথিয়ন টেকনিক্যাল, সাইফেনোথ্রিন (৫ ই.সি.) অথবা ডেল্টামেথ্রিন (১.২৫ ইউএলভি)। সাধারণ ভাবে পুরসভাগুলি থেকে মশা মারতে যে ধোঁয়া দেওয়া হয়, সেটা থার্মাল ফগিং। এতে ডিজেলের পরিমাণ অনেক বেশি লাগে, এক হেক্টরে ১০ লিটার। চোখে দেখা যায় বলে নাগরিকদের আস্থা অর্জনে এই পদ্ধতি বেশি কার্যকরী। এবার অন্য একটি প্রসঙ্গের অবতারণা হয়তো অন্যায় হবে না। বিভিন্ন সময়ে নানা সংস্থার পক্ষ থেকে ইডিস মশা দমনে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হয়। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে নিশ্চিত ভাবেই ব্লিচিং-এর কিছু ভূমিকা আছে, কিন্তু মশা দমনে এর কার্যকারিতা প্রমাণ সাপেক্ষ। তাই এ সব থেকে বিরত থাকাই ভাল।

সবশেষে যে কথাগুলি পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন— জনসচেতনতার উপর নির্ভর করছে ডেঙ্গি প্রতিরোধের সাফল্য। শুধু রেডিয়ো, টেলিভিশনে প্রচার বা ফেস্টুন টাঙানোতে সীমাবদ্ধ না রেখে এলাকাভিত্তিক নাগরিক সভা, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নিবিড় প্রচার চালানো দরকার। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ক্লাবগুলিকে এ কাজে যুক্ত করতে হবে। মশা সার্ভে ও দমনের কাজে নিযুক্ত কর্মীদের পতঙ্গবিদদের তত্ত্বাবধানে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, সঙ্গে নিয়মিত কাজের মূল্যায়ন। এলাকাভিত্তিক মশার তথ্যপঞ্জি তৈরির বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। মশা দমনে প্রকৌশল নির্বাচন করতে হবে সুচিন্তিত ভাবে।

সকলের সমবেত উদ্যোগেই এই মশা ও মারণরোগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। (শেষ)

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং পতঙ্গবিদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dengue Awareness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE