কাজাখ্স্তানের আলমা আটায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে তৈরি হল প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঘোষণাপত্র।
১৯৭৮ সালের ৬ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজাখ্স্তানের আলমা আটায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে তৈরি হল প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঘোষণাপত্র। দাবি তুলল সবার জন্য স্বাস্থ্যের। ভারত-সহ আরও ১৩৪টি দেশ স্বাক্ষর করল সেই ঘোষণায়, যা এক ধাক্কায় স্বাস্থ্যকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের চৌহদ্দির বাইরে টেনে এনে দাঁড় করাল বৃহত্তর সমাজের আঙিনায়। তাঁরা বললেন, দেশে দেশে, দেশের ভিতরে মানুষে মানুষে বেড়ে চলা স্বাস্থ্যগত বৈষম্য কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। গরিব মানুষেরা বেশি রোগে পড়বে, বেশি ভুগবে, পয়সার অভাবে ঠিক সময়ে ঠিক চিকিৎসা পরিষেবা পাবে না, এবং পরিণামে বেশি মরবে— উন্নয়নশীল দুনিয়ায় এমন ছবি থাকতে পারে না। এই বৈষম্য নিশ্চিত ভাবেই আর্থসামাজিক, অতএব রাজনৈতিক। এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী।
কী ভাবে ঘুচবে এই অসাম্য? বিভিন্ন বিকল্প পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে শিক্ষা নিয়ে, আলমা আটা আস্থা জ্ঞাপন করেছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়, যা কিনা অবস্থানগত ভাবে সব চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের সব চেয়ে কাছের এবং যা অধিকাংশ রোগ মোকাবিলায় সক্ষম। আলমা আটা বলল, এই সুস্বাস্থ্য বা ভাল থাকা কিন্তু শুধু চিকিৎসা পরিষেবার বিষয় নয়। সহজলভ্য চিকিৎসার পাশাপাশি এক সর্বাঙ্গীণ স্বাস্থ্যের ধারণা (রোগ প্রতিরোধ, নিরাময়, এবং পুনর্বাসন), সবার পাতে বছরভর পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান, স্বাস্থ্য বিষয়ে গোষ্ঠীর স্বনির্ভরতা ও স্বনির্ণায়ক ক্ষমতা ইত্যাদিও সমান তালে অপরিহার্য সবার সুস্বাস্থ্যের জন্য। তাই, জনস্বাস্থ্য শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব হতে পারে না। প্রয়োজন শিক্ষা, অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজকল্যাণ, শ্রমদফতর, কৃষি, সকলের সমবেত প্রচেষ্টার। স্বাস্থ্য মানে শুধু রোগের অনুপস্থিতি নয়, বরং সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক ভাবে ভাল থাকা। তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক উন্নয়ন, এটাই আলমা আটার বক্তব্য।
কিন্তু, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কবরে ঠেলে দেওয়া হল এই অনুভবকে। না, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়েছিল ভারত, কিন্তু তাতে বহিরঙ্গে পরিবর্তন এলেও, প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। যে বৃহত্তর সামাজিক স্বাস্থ্যকল্পনা ছিল আলমা আটার কেন্দ্রে, সেখান থেকে সরে এসে স্বাস্থ্যের অর্থ গিয়ে ঠেকল শুধুই চিকিৎসা পরিষেবায়। ফলত অসাম্যজনিত ক্ষতে মলমপট্টির জোগান হয়তো ঘটল, কিন্তু অসাম্যকে রোখা গেল না।
আশির দশকের শুরুর দিক থেকে বিশ্ব রাজনীতির পালাবদল এবং পাশাপাশি অর্থনৈতিক অভিমুখের পরিবর্তন সমগ্র বিশ্বে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরিকল্পনা ও নীতির আমূল পরিবর্তন ঘটায়। প্রথমেই আলমা আটা ঘোষিত স্বাস্থ্যের জন্যে সার্বিক সামাজিক উন্নয়নের ধারণাকে উড়িয়ে দেওয়া হয় অবাস্তব বলে, জোর দেওয়া হতে থাকে বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর, কারণ সেগুলি তুলনামূলক ভাবে সহজসাধ্য। পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিষেবারও বেসরকারিকরণ ঘটতে থাকে। স্বাস্থ্যক্ষেত্র ক্রমশ পরিণত হতে থাকে বাজারে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশও স্বভাবতই এই আর্থ-রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে বেরোতে পারেনি এবং যার ফলে পুঁজির স্বাভাবিক নিয়মে স্বাস্থ্য একটি পরিষেবা থেকে আজ পর্যবসিত হয়েছে এক মুনাফা উৎপাদক পণ্যে।
ভারতের তিনটি স্বাস্থ্যনীতিতে চোখ রাখলেই ধরা পড়বে এই ক্রমপরিবর্তন। ফলত উন্নত মানের স্বাস্থ্যপরিষেবা ক্রমশ বেরিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। বাড়ছে চিকিৎসার খরচ, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, স্বাস্থ্যপরীক্ষার বোঝা। সম্প্রতি খবরে এসেছে কী ভাবে রাজধানী দিল্লিতেও প্রাইভেট হাসপাতালগুলো মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ১৭০০ শতাংশেরও বেশি মুনাফা লুটছে। কর্নাটক, দিল্লির মতো রাজ্যগুলো আইন প্রণয়ন করেও বেসরকারি হাসপাতালের বাণিজ্যিক রমরমা আটকাতে ব্যর্থ। ২০১৫ সালের অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে ভারতের ছয় কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে গিয়েছে শুধু স্বাস্থ্য নামক পণ্যের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে। দেখা যাচ্ছে অসাম্য মেটানোর পরিবর্তে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিজেই হয়ে উঠছে অসাম্যের কারণ। পশ্চিমবঙ্গে বা গোটা দেশেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের ক্ষোভ তারই প্রকাশ। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যনীতিও কোনও দিক-নির্দেশ করে না। উল্টে আশঙ্কা যে, ঢক্কানিনাদ-সহকারে ঘোষিত প্রকল্পগুলি (যেমন আয়ুষ্মান ভারতের অধীন ন্যাশনাল হেলথ প্রোটেকশন স্কিম) মদত দেবে কর্পোরেট হাসপাতাল, স্বাস্থ্যবিমা-সহ স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদেরই। স্বাস্থ্য পরিষেবা তাই রাষ্ট্রের কাছে বাজার অর্থনীতির বাইরে নয়, বরং তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-চুক্তি ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির দাবি মেনেই বিদ্যমান।
সুতরাং এ প্রশ্ন করা যেতেই পারে, যদি বিশ্ব এবং জাতীয় রাজনীতির জন্যে স্বাস্থ্যনীতির পরিবর্তন হয়, তা হলে স্বাস্থ্য কেন রাজনীতির বিষয় হয়ে উঠবে না? কেন এই দেশে স্বাস্থ্যের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলি ভোট লড়বে না? কবে স্বাস্থ্যের জন্যে রাজনৈতিক আন্দোলন হবে? অসুস্থের জন্যে সুলভ স্বাস্থ্য পরিষেবা অবশ্যই জরুরি, কিন্তু অসুস্থ না হওয়াটা যে আরও বেশি জরুরি, সেই রাজনৈতিক বোধের অভাবে স্বাস্থ্য নিয়ে দাবিদাওয়া আজও সংযুক্ত হতে পারছে না রুটি, কাপড়, বাসস্থানের সামাজিক দাবির সঙ্গে।
বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদ, প্যাথলজি শাস্ত্রের জনক, রুডল্ফ ভারশ’ বলেছিলেন, চিকিৎসাশাস্ত্র হল আদতে সমাজবিজ্ঞান, আর রাজনীতি বৃহৎ পরিসরে চিকিৎসাশাস্ত্র। আলমা আটার নির্যাসও ছিল তাই— সমাজে ঐতিহাসিক ভাবে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈষম্য না মিটলে স্বাস্থ্যে বৈষম্য ঘোচার সম্ভাবনা নেই। আর এই অসাম্যের প্রশ্ন অবশ্যই এক রাজনৈতিক প্রশ্ন; প্রতিস্পর্ধা, প্রতিরোধ, আন্দোলনের প্রশ্ন। আলমা আটা-র চল্লিশ বছর বাদে আজ সবার জন্যে স্বাস্থ্যের দাবিকে তাই আমরা পরিষেবা, পণ্য, না কি সামাজিক সাম্যের অধিকার অর্জনের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখব, তা আমাদের রাজনীতিই একমাত্র ঠিক করতে পারে।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে
জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy