Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ভূরিভোজ

সমাজসেবা, পরিবেশবন্ধুতা, মানবাধিকার প্রভৃতির প্রতিফলন এখন পূজার আয়োজন, মণ্ডপসজ্জা ও প্রতিমার নির্মাণে মিলিয়া থাকে। তাঁহাদের সেই চিন্তাকে আরও প্রসারিত করিতে হইবে। দর্শনার্থীকে সক্রিয় যোগদানকারী হইতে কী করিয়া উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহা চিন্তা করিতে হইবে।

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

রসনার তৃপ্তি না হইলে উৎসবের সমাপ্তি হয় না। অতএব পূজার দিনগুলিতে একটি প্রধান প্রশ্ন, ঘরে-বাইরে কবে, কী কী খাওয়া হইবে। একত্রে বসিয়া ভোজনে যে আন্তরিকতার বন্ধন তৈরি হয়, তাহার তুলনা নাই। তাই যে কোনও উদ্‌যাপনের সহিত সুখাদ্যের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। প্রায় প্রতিটি ধর্মে সকলে উপবাস করিবার পর একত্রে ভোজনের নির্দেশ রহিয়াছে। কিন্তু ধর্মশাস্ত্র যখন সহাস্যে প্রশ্রয় দিতেছে, তখন ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া আছে চিকিৎসাশাস্ত্র। নবমীর পাঁঠার মাংসের বাজারদর অগ্রাহ্য করিতে পারেন, ক্যালরির মাপ ভুলিবেন কী করিয়া? তাহার পর বিজয়ার পায়েস, মিষ্টান্ন-সহ আতিথেয়তা রক্তে শর্করা, কোমরে মেদ বাড়াইবে। ভাসন্ত তেলে কড়মড়ে করিয়া ভাজা বিবিধ সুখাদ্য মন ভরাইয়া দেয়। বিজয়া একাদশীর নাড়ু-মালপোয়া হইতে শুরু করিয়া ক্রিসমাসের কেক-পুডিং অবধি সুখাদ্যের নিরন্তর আহ্বান। এমনকী নূতন বৎসরে মেদ কমাইবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হোঁচট খাইয়া যায় পৌষপার্বণের পিঠা-পাটিসাপটার থালিতে। সুখাদ্যের ঘ্রাণ, সহৃদয় নিমন্ত্রণ আমাদের উদর মেলিয়া উদার হইতে আহ্বান করে। আর সুস্বাস্থ্যের বিধান সতর্ক, নিজের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ হইতে নির্দেশ দেয়। এই দুইটির যে সংঘাত, তাহাতে প্রত্যেকেই দীর্ণ হয়। যে বিধি লঙ্ঘন করিয়া খাইয়া ফেলে, সে রসনা-শাসনে ব্যর্থতার জন্য মনে মনে লজ্জিত থাকে। দুর্বল, অসংযত হইবার জন্য সংকোচ বোধ করে। আর যাহারা খাইবার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, তাহাদের অতি-সাবধানী, স্বাস্থ্যসর্বস্ব হইবার জন্য বিদ্রুপ সহিতে হয়। নিজের প্রতি কৃপণ হইয়া, আত্মবঞ্চনা করিয়া সুখ কী? আর অসুখী হইলে সুস্বাস্থ্য লইয়া কী হইবে?

কথাটি বুঝিয়াছিল শশী ডাক্তার। স্বাস্থ্যের বিধির সহিত যখন জীবনযাত্রার রীতির সংগতি থাকে না, তখন পিছু হটিতে হয় স্বাস্থ্যকেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের এই গ্রামের তরুণ শহরে ডাক্তারি পড়িয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক হইয়া ওঠে, কিন্তু নিজের পরিবারে আধুনিক স্বাস্থ্যবিধি চালু করিতে পারে নাই। মায়েরা মাটিতে মুড়ি ঢালিয়া খাইতে দিবে শিশুকে, গৃহিণীরা দুপুরে ঘুমাইবে, সন্ধ্যা না ইহতে সকলে জানালা বন্ধ করিয়া বদ্ধ ঘরে জড়ো হইবে। শশীর নির্দেশ তাহাদের নিকট অন্যায় অত্যাচার বলিয়া বোধ হইতে থাকে, তাহারা বিদ্রোহ করে, নালিশ করে। শশী ক্রমশ উপলব্ধি করে, ‘স্বাস্থ্যের সঙ্গে, প্রচুর জীবনীশক্তির সঙ্গে ওদের জীবনের একান্ত অসামঞ্জস্য।’ সে বুঝিতে পারে, অস্বাস্থ্যকর জীবনে যাহারা স্তিমিত শান্তিতে রহিয়াছে, সতেজ জীবন তাহাদের সহিবে না।

সমকালের চিকিৎসকদের উপলব্ধি কি ভিন্ন? তাঁহারাও কর্তব্যবশে রোগীদের সংযত ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার নানা বিধান দেন। কিন্তু জানেন যে, তাহার অধিকাংশই উপেক্ষিত হইবে। এমনকী তাঁহারা নিজেরাও স্বাস্থ্যবিধি মানিয়া চলেন, এমন নহে। অতএব আনন্দময় সামাজিক জীবনযাত্রার সহিত স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সতেজ জীবনের সংগতি সাধনের উপায় খুঁজিতে হইবে। একটি পথ বরাবরই ছিল। তাহা খেলাধুলা। যে কোনও উৎসব উপলক্ষে প্রতিযোগিতা বা ‘টুর্নামেন্ট’ আয়োজন বাংলার ঐতিহ্যই ছিল। ব্যায়ামের আখড়া, লাঠি খেলিবার প্রশিক্ষণও কলিকাতার পুরাতন ধারা। সেগুলির পুনরাবিষ্কার করিয়া ফের তাহার প্রচলন করা প্রয়োজন। তাহাতে সম্মিলিত আনন্দের স্বাদ মিলিবে। পূজা কমিটিগুলি নূতনত্বের সন্ধানে বিচিত্র উদ্ভাবন করিতেছে। সমাজসেবা, পরিবেশবন্ধুতা, মানবাধিকার প্রভৃতির প্রতিফলন এখন পূজার আয়োজন, মণ্ডপসজ্জা ও প্রতিমার নির্মাণে মিলিয়া থাকে। তাঁহাদের সেই চিন্তাকে আরও প্রসারিত করিতে হইবে। দর্শনার্থীকে সক্রিয় যোগদানকারী হইতে কী করিয়া উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহা চিন্তা করিতে হইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Food Bengali Durga Puja Puja Committee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE