অগ্নিগর্ভ জম্মু, পিছনে জ্বলছে গাড়ি, তার মধ্যেই তুমুল বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
ক্রোধে ফুঁসছে গোটা দেশ। পুলওয়ামার রক্তাক্ত আখ্যানের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে— দাবি উঠছে আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে। আক্রোশ এতটাই যে, শব্দচয়ণে সংযম বা পরিশীলনের কথা অনেক সময় খেয়াল থাকছে না বিহ্বল নাগরিকের। প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ— কোটি কোটি ভারতীয় নাগরিকের বুক থেকে ঠিকরে আসছে এই সাংঘাতিক রোষ। অস্বাভাবিক নয় এই আক্রোশটা। সন্ত্রাসবাদীদের এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বসে থাকা সন্ত্রাসের মদতদাতাদের মুখ-ভাঙা জবাব দেওয়ার দাবিটা আজ মোটেই অবান্তর শোনাচ্ছে না। কিন্তু কেউ কেউ ভুলে যাচ্ছেন, যুদ্ধটা বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে। দেশের মধ্যেই একটা বিরাট জনগোষ্ঠীকে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দেওয়ার এক চূড়ান্ত অন্যায় চেষ্টা শুরু হয়েছে। দেশের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার এই চেষ্টা বন্ধ না হলে বিপদ আরও বাড়বে বই কমবে না।
বৃহস্পতিবার ভয়াবহ জঙ্গি হামলাটার খবর পাওয়ার পরে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল গোটা দেশ। শোকে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল সমগ্র ভারত। শুক্রবার সেই শোক ছাপিয়ে মাথা তুলেছে আক্রোশ। হামলাকারী সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদকে শেষ করে দেওয়ার দাবি মুখে মুখে ফিরছে। জইশ যে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতপ্রাপ্ত সংগঠন, তা কারও অজানা নয়। কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে সরকারকে সে কথা হয়তো একটু রাখঢাক করে বলতে হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকের সে বাধ্যবাধকতা নেই। ভারতের সাধারণ নাগরিকরা পাকিস্তানকে অবিলম্বে উচিত শিক্ষা দেওয়ার দাবিতে ফুঁসতে শুরু করেছেন। উত্তাল হয়েছে জম্মু। প্রতিশোধ নেওয়ার প্রশ্নে কোনও আপোস নয়, বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ নয়, এখনই বদলা চাই— এই দাবিতে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে জম্মু শহরে তাণ্ডব চালিয়েছেন একদল। কারফিউ জারি করে, সেনা নামিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রশাসনকে। দেশের অন্যান্য প্রান্তেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র পাকিস্তান বিদ্বেষ ও বিষোদগার। বিদ্বেষ বা বিষোদগার বা জিঘাংসা আদ্যন্ত ইতিবাচক বিষয়, এমনটা নয়। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে সন্ত্রাসে রক্তাক্ত হতে থাকা ভারতবাসী যখন নতুন করে আরও একটা বীভৎস হত্যালীলার সাক্ষী হল, তখন এই প্রতিহিংসার বাসনা খুব অপ্রত্যাশিত নয়।
গোটা দেশ আজ ঐক্যবদ্ধ। মতান্তর ভুলে, বিভেদ ভুলে, রাজনীতি ভুলে নাগরিক একাত্ম শহিদদের পরিবারের সঙ্গে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে, তিক্ততা সরিয়ে রেখে পরস্পরের পাশে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বিপদের ক্ষণে মজবুত ঐক্য গড়ে তোলা, দুঃসময়ে পরস্পরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক লক্ষণ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গেলেন মৃত জওয়ানের কফিন। বিরোধী দল কংগ্রেসের তরফে বারবারই বার্তা দেওয়া হল যে, এই সঙ্কটের ক্ষণে কংগ্রেস থাকবে সরকারের পাশেই। দৃশ্যগুলো ইতিবাচক। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে শহিদ জওয়ানের কফিন বইছেন— এই দৃশ্য গোটা বাহিনীকে উজ্জীবিত করতে পারে। বিরোধীদলের প্রধান রাহুল গাঁধী এসে দাঁড়াচ্ছেন শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের পাশে— এই দৃশ্য গোটা দেশকে ঐক্যের বার্তা দেয়। আর সব মিলিয়ে পূর্ণ উদ্যমে প্রত্যাঘাতের একটা আবহ তৈরি হয়।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
মজবুত ঐক্য এবং অটুট জাতীয় সংহতির যে বার্তা সামনে এল সিআরপিএফ কনভয়ে জঙ্গি হামলার পরে, সে দৃশ্য অত্যন্ত মহার্ঘ। শোকের মাঝে ইতিবাচক বার্তা দেয় এই ছবি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়াচ্ছে একটা বিদ্বেষ বিষও। জঙ্গিদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার দাবি তোলার নামে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে নাগরিকদের মধ্যে। এই বিভাজনের চেষ্টাকে একটুও প্রশ্রয় দিলে চলবে না।
পুলওয়ামায় হামলাটা চালিয়েছে জইশ-ই-মহম্মদ। এই জইশের সঙ্গে ইসলামকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, ইসলামের নামটা টেনে সব মুসলমানকে জঙ্গি আখ্যা দেওয়ার একটা অপচেষ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় এক অংশ চালাচ্ছেন। এই চেষ্টাটা বা এই প্রবণতাটা খুব বিপজ্জনক। যখন জঙ্গিকে জবাব দিতে প্রস্তুত হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী, দেশের মধ্যে তখন প্রত্যেক নাগরিককে প্রস্তুতি নিতে হবে এই বিভাজনের চেষ্টা সর্বশক্তিতে রুখে দেওয়ার।
আরও পড়ুন: ‘প্রতিশোধ চাই’! পাকিস্তান বিরোধী মিছিলে অগ্নিগর্ভ জম্মু, জারি কার্ফু
আক্রান্ত হয়েছে ভারত। অর্থাৎ আক্রান্ত হিন্দু, আক্রান্ত মুসলমান, আক্রান্ত শিখ-বৌদ্ধ-জৈন-খ্রিস্টান-পার্সি এবং অন্য যে কোনও মতাবলম্বীর মানুষ। কারণ, এই দেশটা প্রত্যেকের। অতএব, প্রত্যেকে আজ শত্রুকে জবাব দিতে ঐক্যবদ্ধ। ভারত জুড়ে তৈরি হওয়া সেই সুবিশাল ঐক্যটাই ভয়ঙ্করতম আঘাত হানতে পারবে শত্রুর শিবিরে, এ কথাটা আমাদের মাথায় রাখতেই হবে। তার বদলে যদি বিভাজনের চেষ্টাটাকে আজ প্রশ্রয় দিই, যদি এই দেশের নাগরিকদের একাংশকেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই, তাহলে কিন্তু যুদ্ধের আগেই হেরে বসে থাকব। ভারতের শত্রুদের লক্ষ্য কিন্তু শুধু ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে আঘাত করা নয়। শত্রুদের লক্ষ্য ভারতকে টুকরো টুকরো করা। ভারতীয়রা নিজেরাই যদি সে কাজটা সহজ করে দেন, তাহলে পরিস্থিতিটা দুর্ভাগ্যজনক হয়ে ওঠে। নিজেরাই যদি আমরা ফাটল তৈরি করি দেশের অন্দরে আজ, তাহলে অচিরেই সেই ফাটল দিয়ে আমাদের অভেদ্য দুর্গে ঢুকে আসবে বহিঃশত্রু— এই সহজ সত্যটুকু উপলব্ধি না করতে পারার কোনও কারণ নেই।
সঙ্কল্পবদ্ধ হন— শত্রুকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে, ঐক্যবদ্ধভাবে দিতে হবে, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি তৈরি করে নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy