শ্রীনিকেতন ঘুরে দেখছেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। ফাইল ছবি
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, সে তুলনায় তাঁর অন্য কয়েকটি দিক অনালোচিত থেকে যায়। যেমন, বাংলার কৃষক ও কৃষির উন্নতির জন্য তাঁর ভাবনা। শুধু ভাবনাই নয়, তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তার রূপায়ণে পদক্ষেপও করেছিলেন। তাঁর কৃষির উন্নতি ও পল্লিসংগঠন নিয়ে ভাবনা ও কাজ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞেরা আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, শিলাইদহ, পতিসর অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের পল্লিসংগঠন প্রকল্প, শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে কৃষি ও হস্তশিল্পের মাধ্যমে স্বনির্ভরতার উদ্যোগ এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকের একেবারে শেষ লগ্নে শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর অঞ্চলের জমিদারির দায়িত্ব নেন। তখন এই সব অঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। এই ব্যবস্থায় গ্রামবাসীর জীবন ও জীবিকা দুই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। চাষ করে লাভ তো দূরের কথা, করের ভারে প্রজাদের জীবন ছিল জর্জরিত। তার উপরে ছিল ঋণের চাপ। প্রজা বা রায়তের সঙ্গে জমিদারের প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক ছিল না। দরিদ্র প্রজার কাছে জমিদার ছিলেন ভয় ও শক্তির উৎস।
সে কালের পল্লিজীবনে রাজা ও প্রজার এই সম্পর্কের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ওয়াকিবহাল ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর একটি লেখায় পাওয়া যায়, ‘প্রজারা যখন কোনো একটা বিষয়ে একটু বেশি জিদ করিয়া বসে তখন গবর্মেণ্ট তাহাদের অনুরোধ পালন করিতে বিশেষ কুন্ঠিত হইয়া থাকেন, পাছে প্রজা প্রশ্রয় পায়।’ এই কথাটিই সে কালের প্রায় সব জমিদারি সম্পর্কেই বলা যেত। এই সমস্যা মেটাতে রবীন্দ্রনাথ নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে জমিদারি অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল ‘গ্রামহিতৈষী সভা’। এর কাঠামোটি ছিল অনেকটাই এখনকার ক্রেতা সুরক্ষা সমিতির মতো। বাংলার গ্রামগুলি তাঁদের অন্তর্নিহিত শক্তির জোরে যাতে স্বয়ম্ভর সমাজে রূপান্তরিত হয়, সেটাই ছিল এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষে তিনি তাঁর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত কালীগ্রাম পরগনাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রতি গ্রাম থেকে এক জন করে প্রজাকে নির্বাচিত করে এবং জমিদারির এক জনেক মনোনীত করে, গ্রামবাসীদের নিয়ে গড়ে তোলা হত এই হিতৈষী সভা। কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভা নিয়ম করে, বিভিন্ন সভা ও বার্ষিক সাধারণ সভার আয়োজন করত। এই সব সভার মাধ্যমে বিবিধ জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হত। পাশাপাশি, কোনও প্রজার উপরে জমিদার বা তাঁর প্রতিনিধিরা অবিচার, অত্যাচার করলে সেই সব বিষয় সম্পর্কে জমিদারকে অবহিত ও সতর্ক করা হত।
তাঁর পরিকল্পনার স্বরূপ বিচার করলে দেখা যায়, পতিসরই হোক বা শ্রীনিকেতন, রবীন্দ্রনাথ মূলত পিছিয়ে থাকে ভারতীয় কৃষির উন্নয়নে চেষ্টা করেছিলেন। পল্লিসংগঠনের কাজকে সম্প্রসারিত করাও এই কৃষির উন্নতির একটি সোপান বলে মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। পল্লিসংগঠনের কাজকে সম্প্রসারিত করতে তিনি ক্ষুদ্রস্তরে কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক প্রকল্প স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। যেগুলির সফল রূপায়ণ সারা দেশে কৃষি ও গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করবে, এই ছিল তাঁর ভাবনা। এই কাজের জন্য তিনি সমকালীন আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর এই মতের প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’তে। তিনি সেখানে লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে কোনো এক সময়ে গোবর্ধনধারী কৃষ্ণ বোধ হয় ছিলেন কৃষির দেবতা, গোয়ালার ঘরে তাঁর বিহার; তাঁর দাদা বলরাম, হলধর। ঐ লাঙল-অস্ত্রটা হল মানুষের যন্ত্রবলের প্রতীক। কৃষিকে বল দান করেছে যন্ত্র। আজকের দিনে আমাদের কৃষিক্ষেত্রের কোনো কিনারায় বলরামের দেখা নেই— তিনি লজ্জিত— যে-দেশে তাঁর অস্ত্রে তেজ আছে সেই সাগরপারে তিনি চলে গেছেন। রাশিয়ায় কৃষি বলরামকে ডাক দিয়েছে, দেখতে দেখতে সেখানকার কেদারখণ্ডগুলো অখণ্ড হয়ে উঠল, তাঁর নূতন হলের স্পর্শে অহল্যাভূমিতে প্রাণসঞ্চার হয়েছে।’ ভারতবর্ষীয় কৃষিতেও যে প্রাণসঞ্চারের জন্য যন্ত্রের প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল সে কথা রবীন্দ্রনাথ পরোক্ষ ভাবে মেনে নিয়েছিলেন। তিনি কৃষির আধুনিকীকরণ ও পল্লিমঙ্গল চিন্তাকে সমন্বিত করে এক পূর্ণাঙ্গ গ্রামোন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
সমালোচকদের একাংশের মতে, ‘সমবায়’ ভাবনারও অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এখানে সমবায় সম্পর্কিত রবীন্দ্র ভাবনার একটি দৃষ্টান্ত আলোচনা করা যাক। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এমনি করিয়া অনেক গৃহস্থ অনেক মানুষ একজোট হইয়া জীবিকানির্বাহ করিবার যে উপায় তাহাকেই য়ুরোপে আজকাল কোঅপারেটিভ-প্রণালী এবং বাংলায় ‘সমবায়’ নাম দেওয়া হইয়াছে। আমার কাছে মনে হয়, এই কোঅপারেটিভ-প্রণালীই আমাদের দেশকে দারিদ্র্য হইতে বাঁচাইবার একমাত্র উপায়। আমাদের দেশ কেন, পৃথিবীর সকল দেশেই এই প্রণালী একদিন বড়ো হইয়া উঠিবে।’
রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পর্বের কর্মযজ্ঞ আরম্ভ হয় শিলাইদহ, পতিসর পর্বের প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি বছর পরে, শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দিতে। রবীন্দ্র সমালোচকদের একাংশ মনে করেন, শিলাইদহ পর্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাফল্য ও ব্যর্থতা-সহ যাবতীয় অভিজ্ঞতাই তাঁর এই পর্বের কাজের জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতন পর্বে রবীন্দ্রনাথ কৃষি পল্লিজীবনের উন্নতির জন্য যে কৌশলগুলি অবলম্বন করেছিলেন তা সে কালে তো বটেই, এখনও মডেল হয়ে রয়েছে।
১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন লাগোয়া সুরুল গ্রামে একটি পুরনো কুঠিবাড়ি কিনেছিলেন। তার কিছুদিন পরে স্থানীয় জমিদারের কাছ থেকে কুঠিবাড়ি লাগোয়া বিস্তীর্ণ জমি কিনে নেন। এই ভাবে সুরুল গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে শ্রীনিকেতনের পল্লি সাংগঠনিক কর্মযজ্ঞ। এই কাজে অন্যতম ভূমিকা ছিল রবীন্দ্র অনুরাগী লেনার্ড এলমহার্স্ট। তিনি ছিলেন কৃষিবিদ। তাঁর উদ্যোগেই শ্রীনিকেতনে কৃষি গবেষণা শুরু হয়। অর্থে দিয়ে সহায়তা করেন ডরোথি স্ট্রেট। সঙ্গে হস্তকারুশিল্পের বিষয়েও কাজ শুরু হয়। চামড়া, সূঁচ, মাটি ও গালার কাজ, শতরঞ্চি বুনন, ব্লক ছাপা যন্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। জেলা থেকে শিল্প সংগ্রহ শুরু হয়। চট্টগ্রামের মহিলাদের শিল্প, লক্ষ্মীপুজো, বিয়ে উপলক্ষে আলপনা, কাঁথা প্রভৃতি গৃহস্থালির দ্রব্য, মাটির, বাঁশের, বেতের কাজ, শাড়ির পাড়ের নকশা নিয়ে কাজ শুরু হয়। ১৯২৭ সালে স্থাপিত হল সমবায় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। অবশ্য তার আগেই ছিল স্থানীয় উদ্যোগে তৈরি পল্লীউন্নয়ন সমিতি, সমবায় স্বাস্থ্য সমিতি, ধর্মগোলা, কৃষিঋণদান সমিতি, সেচ সমবায় এবং সমবায় বয়ন সমিতি। এক কথায় পল্লিজীবনের উন্নতির জন্য যাবতীয় অনুষঙ্গ এই প্রকল্পে স্থান পেয়েছিল।
শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ বীজ থেকে মহীরুহ হয়ে ওঠে। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৩৩ সংখ্যায় লেখা হয়েছিল, ‘শ্রীনিকেতনের কর্মীরা কেবল মৌখিক উপদেশ দ্বারা নহে, পরন্তু কাজ করিয়া এবং কাজ করিতে শিখাইয়া এই সমুদয় গ্রামবাসীকে স্বয়ং নিজের হিতে কাজ করিতে সমর্থ হইয়াছেন। এই জন্য ইহার কাজের বিস্তৃতি, স্থায়ীত্ব ও সাফল্য সর্বতোভাবে বাঞ্ছনীয়।’ ভারতের কৃষি ও গ্রাম উন্নয়নের জন্য এই কাজটিতেই আরও জোর দেওয়ার প্রয়োজন।
বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy