Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

হার জিত পরের কথা

প্রদেশ কংগ্রেসের নানা নেতায় বোঝাই গোটা চত্বর। তার মাঝে এমন একটা প্রশ্ন মানে মূর্তিমান বিড়ম্বনা! তিনি আবার খোঁচালেন, ‘‘সচ বতাইয়ে’’। দু’কূল রেখে তাঁকে বলা হল, ওঁরা কাজ করেন, নামও চান।

সন্দীপন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

জায়গাটার নাম নেদুম্বসেরি। কোচি-র শহরতলিতে সাংবাদিক সম্মেলনের পরে মধ্যাহ্নভোজ। ক্যামেরার ঠেলাঠেলি নেই, এসপিজি-র গুঁতো নেই! খাবারের প্লেট হাতে ঘুরে ঘুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করছেন তিনি। কলকাতার লোক, শুনে কাগজ নিয়ে দু’তিনটে কথা বলেই সটান প্রশ্ন: ‘‘আচ্ছা, ওখানে কংগ্রেস আন্দোলন করে? রাস্তায় কংগ্রেসকে দেখা যায়?’’ তখন ২০০৯ লোকসভা ভোটের প্রচার চলছে কেরলে। বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। সে সবে না গিয়ে যুব কংগ্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদকের প্রথম প্রশ্ন ছিল দলের সক্রিয়তা নিয়ে। পরে তাঁর দফতর থেকে মেল এল: আলাপ করে রাহুল গাঁধী খুশি, যোগাযোগ বজায় রেখে আরও অনেক কিছু জানতে চান।

পরের মুখোমুখি সাক্ষাৎ দু’বছর বাদে, কলকাতায়। তখন কংগ্রেস-তৃণমূল জোট বাংলায় বাম সরকারের বিরুদ্ধে ‘পরিবর্তন’-এর হাওয়া তুলেছে। বাইপাসের ধারে এক হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলনের পরে প্রাতরাশের টেবিলে তিনিই আবার প্রশ্ন করলেন। এখানকার নেতারা কাজ করেন? না কি শুধুই সাংবাদিকদের ধরে নাম ছাপানোর জন্য তদবির করেন? প্রদেশ কংগ্রেসের নানা নেতায় বোঝাই গোটা চত্বর। তার মাঝে এমন একটা প্রশ্ন মানে মূর্তিমান বিড়ম্বনা! তিনি আবার খোঁচালেন, ‘‘সচ বতাইয়ে’’। দু’কূল রেখে তাঁকে বলা হল, ওঁরা কাজ করেন, নামও চান। হেসে ফেললেন তিনি। গালে টোল পড়ল। বললেন, ‘‘ইন্টেলিজেন্ট ওয়ান!’’

রাজনীতিক রাহুল গাঁধীকে ‘ইন্টেলিজেন্ট’ মানতে আপত্তি আছে অনেকেরই। নরেন্দ্র মোদীর সম্মোহনী বাক্শক্তির সঙ্গে তুলনায় তিনি নেহাতই ম্যাড়মেড়ে। ইন্দিরাসুলভ ব্যক্তিত্ব নেই, রাজীবসুলভ ক্যারিশমা নেই। গলার স্বরে দৃঢ়তাও নেই। বিরোধীদের কটাক্ষে কখনও পাপ্পু, কখনও যুবরাজ, কখনও মিকি মাউস! ইদানীং একটু কমলেও সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে নানা রসিকতা। ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের প্রধান সেনাপতি হিসেবে বিজেপিকে পরাস্ত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরও সময়ের গর্ভে। কিন্তু ১৩৩ বছরের পুরনো একটা দলে নতুন রক্তসঞ্চারের জন্য পরিশ্রম করছেন বটে এই তরুণ নেতা!

তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির সঙ্গে তুলনা টেনেই একটু দেখা যাক প্রথমে। সংগঠন প্রসারের জন্য ‘জনসম্পর্ক অভিযান’-এর প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন অমিত শাহেরাই। রাজ্যে রাজ্যে বুথ পর্যন্ত সংগঠনকে নিয়ে যাওয়ার অভিযান চলাকালীনই শাহ সেখানে গিয়েছেন, প্রত্যন্ত জেলা বা শহরে কোনও বাড়িতে বসে পাত পেড়ে খেয়েছেন। সংবাদমাধ্যমে বড় খবর হয়েছে। কিন্তু তার পরে? এই বাংলাতেই শাহ ঘুরে যাওয়ার পরে বিজেপি আর সেখানে সংগঠন ধরে রাখতে পারেনি, এমন উদাহরণ আছে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল সেই পরিকল্পনাই নিয়ে এলেন ‘লোক সম্পর্ক’ নামে। কিন্তু কংগ্রেসের সব রাজ্য শাখাকে জানিয়ে দেওয়া হল, এলাকায় এলাকায় জনসংযোগ স্থাপনের কাজ স্থানীয় নেতা-কর্মীদেরই করতে হবে। সনিয়া বা রাহুল গাঁধী এক দিন গিয়ে প্রচারের আলো কাড়তে পারেন, কিন্তু তাতে সংগঠনের জন্য কাজের কাজ কিছু হবে না। দ্বিতীয়ত, বলা হল, ‘লোক সম্পর্ক’-এর সময়ে কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা এলাকার মানুষের কাছে গিয়ে দলের বক্তব্য শোনানো এবং মানুষের কথা শোনার পাশাপাশিই চাঁদার কুপন নিয়ে যাবেন। দলের তহবিলের জন্য চাঁদা চাইতে হবে জনদরবারেই। জনতার কাছে হাত পেতে দল চালানোর কথা বলা স্মরণযোগ্য কালের মধ্যে অন্তত কংগ্রেসে রেওয়াজ ছিল না। স্বাধীনতার আগে যা হয়েছে, সে সুদূর অতীতের কথা।

রাজ্য থেকে নেতারা কিছু হলেই দিল্লিতে হাইকম্যান্ডের কাছে দরবার করেন, এটাও কংগ্রেসে আর এক দস্তুর। রাহুল কী করলেন? সব প্রদেশ কংগ্রেসের দফতরে এলইডি স্ক্রিন লাগাতে বলে জানিয়ে দিলেন, রাজ্য ও জেলা নেতাদের সঙ্গে তিনি ভিডিয়ো কনফারেন্সে কথা বলবেন। আরও নিচু তলার যে কোনও কর্মীর সঙ্গে যাতে কংগ্রেস সভাপতি ফোনে যোগাযোগ করতে পারেন, তার জন্য চালু হল ‘শক্তি’ প্রকল্প— এলাকা ভাগ করে তথ্যভাণ্ডারে থাকবে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর। অর্থাৎ সর্বভারতীয় সভাপতি রাজ্য নেতাদের কাছে দলের সম্পর্কে যা শুনবেন, কর্মীদের কাছে প্রয়োজনে আবার তা যাচাই করে নিতে পারবেন। সর্বোচ্চ নেতার নজরদারির মধ্যে থাকলে রাজ্য বা জেলা নেতারাও কাজে ফাঁকি দিতে পারবেন না!

রাহুলের দফতর থেকেই প্রতি প্রদেশকে বলা হয়েছে, তাদের রাজ্যে সংবাদমাধ্যমে রোজকার ঘটনা ছাড়া ভিন গোত্রের যা খবর বেরোচ্ছে, তার হদিস রাখতে হবে। প্রতি বুধবার নির্দিষ্ট ডেটাবেসে ওই খবর সংক্রান্ত তথ্য আপলোড করতে হবে। সেই সব তথ্যে চোখ বোলাবেন রাহুলই। তার পরে তাঁর যদি সেই খবরের সঙ্গে জড়িত কারও সঙ্গে যোগাযোগের ইচ্ছা হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য নেতৃত্বকে বলা হবে ফোন নম্বর বা ঠিকানা জোগ়়াড় করতে। যেমন, বাংলা থেকে ১২ বছরের একটি মেয়ের উচ্চ মাধ্যমিক দিতে যাওয়ার খবর কংগ্রেস সভাপতির ডেটাবেসে উঠেছে।

নির্বাচনী ইস্তাহারে সব দলের নেতৃত্বই তাঁদের দর্শন অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে থাকেন। রাহুল বদল এনেছেন সেখানেও। সর্বভারতীয় ইস্তাহার কমিটিকে বলা হয়েছে, রাজ্যে রাজ্যে, শহরে শহরে ঘুরে বিষয় ধরে ধরে মত আদানপ্রদানের আসর থেকে শুনতে হবে, মানুষ কী চাইছেন কংগ্রেসের কাছ থেকে। কমিটির এক এক জন সদস্যের জন্য বেছে দেওয়া হয়েছে এক একটি বিষয়। যার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে সচরাচর ‘ব্রাত্য’ পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের মতো বিষয়ও আছে, আবার জনমত নিতে যাওয়ার সময় ইস্তাহার কমিটির সদস্যেরা যাতে সেই নির্দিষ্ট বিষয়ে তথ্যপঞ্জি হাতে নিয়ে যেতে পারেন, তার জন্য পরিশ্রম করছে এআইসিসি-র রিসার্চ শাখা। যাদের কাজ, সম্ভাব্য সব সূত্র কাজে লাগিয়ে নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা। রীতিমতো মাইনে দিয়ে এক ঝাঁক ছেলেমেয়েকে রিসার্চ শাখার কাজ করাচ্ছে এআইসিসি। সর্বভারতীয় শাখার সম্পাদকের পদে এক বঙ্গসন্তান, রণজিৎ মুখোপাধ্যায়, অন্য পরিচয়ে কলকাতার প্রাক্তন নগরপাল প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের পুত্র। দিল্লি রিসার্চ শাখায় জোর দিচ্ছে দেখে রাজ্যগুলিও ক্রমে সে দিকে মন দিতে বাধ্য হচ্ছে।

কংগ্রেসের পুরনো নেতারা ইন্দিরার একটা মন্তব্য কথায় কথায় ব্যবহার করতেন: ‘কংগ্রেস ইজ় আ ফ্রি বার্ড ইন দি ওপেন ব্লু স্কাই।’ মুক্ত বিহঙ্গ যখন, সংগঠনের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ার কিছু নেই, এই ছিল তাঁদের যুক্তি। এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক হয়েই রাহুল অবশ্য হাঁটতে শুরু করেছিলেন অন্য পথে। কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার থাকার সময়েই তিনি গড়েছিলেন ‘আম আদমি কা সিপাহি’। বাংলার অমিতাভ চক্রবর্তী বা বিহারের শাকিক আহমেদ খানেরা ওই শাখার হয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিতেন ইউপিএ-র জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে কোথায় অসুবিধা হচ্ছে। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পেয়ে রাহুল প্রায়শই নানা রাজ্যের ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করতেন ‘টিমওয়ার্ক’-এর ভাবনায় শান দিতে। গোটা কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে সেই রাহুলই এখন একগুচ্ছ অভিনব পরিকল্পনা নিয়ে সংগঠনকে নিজের হাতে গড়তে চাইছেন।

তার মানে কি কংগ্রেসের সংগঠন রাতারাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে? রাজ্যে রাজ্যে নেতাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বন্ধ হয়েছে? জনসংযোগে ঢেউ উঠেছে? উত্তর: না! সংগঠনে ঝাঁকুনিটা টের পাওয়া যাচ্ছে। এই বাংলার নেতাদের সঙ্গেই দিল্লিতে এক বৈঠকে রাহুল বলেছেন, ‘‘হো সকতা হ্যায় কি এক ভি সিট হম নেহি জিতে! লেকিন পার্টি হম বানায়েঙ্গে!’’ তাঁর কণ্ঠস্বর নিয়ে বিরোধীরা ঠাট্টা করতে পারেন। কিন্তু সে দিনের স্বর দৃঢ়ই ছিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE