Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সীমা অতিক্রম

বিরোধীদের সমালোচনার ক্ষেত্রেও বিশ্বাসযোগ্যতার বড় ভূমিকা থাকে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সম্পর্কে রাহুল গাঁধী তিক্ত মন্তব্য করিবেন, তাহাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাই বলিয়া মুসলিম ব্রাদারহুডের সহিত তুলনা টানিবার প্রয়োজন ছিল না।

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

রাহুল গাঁধীর চার দিনের বিদেশ সফরটি রীতিমতো বিতর্কিত হইয়া রহিল। এমন অনেক কথাই তিনি বিভিন্ন বক্তৃতায় বলিলেন, যেগুলি তাঁহার নিজের দেশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিল। এই নেতি-প্রতিক্রিয়া কেবল বিরোধী দল অর্থাৎ ক্ষমতাসীন বিজেপি হইতেই আসিল না, বিজেপি-বিরোধী যে পক্ষ রাহুলকে নেতৃপদে দেখিতে আগ্রহী, তাহাদের দিক হইতেও ধাবিত হইল। সর্বাপেক্ষা গুরুতর সমালোচনা নিশ্চয়ই তাঁহার ১৯৮৪-তে দিল্লির শিখ-নিধন সম্পর্কিত মন্তব্যটিকে ঘিরিয়া। এই নিধনের সহিত কংগ্রেসের যোগ ছিল না, এ কথা বলিয়া রাহুল নিজেকে বিপদের মধ্যে ফেলিয়াছেন। তাঁহার অতি বড় সমর্থকরা হয়তো যুক্তি দিবেন, রাহুল আসলে বলিতে চাহিয়াছিলেন যে দল হিসাবে কংগ্রেস এই নিধনে যোগ দেয় নাই। মুশকিল হইল, রাজনীতির ইতিহাস কোনও কালেই সূক্ষ্ম পার্থক্য মানিয়া চলে না। টাইটলার বা সজ্জন কুমারের মতো প্রথম সারির কংগ্রেসি নেতারা যেখানে অভিযুক্ত, সেখানে কংগ্রেসকে দায়িত্ব স্বীকার করিতেই হইবে। রাহুল গাঁধীর আগে সাম্প্রতিক কোনও কংগ্রেস নেতাই ‘চুরাশির দাঙ্গা’য় কংগ্রেসের দায় অস্বীকার করেন নাই। ২০০৫ সালে নানাবতী কমিশনে কংগ্রেস নেতাদের নামে অভিযোগ উঠিয়া আসায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনাও করিয়াছিলেন। এই প্রেক্ষিতে রাহুল গাঁধীর মন্তব্যটি কাঁচা বলিলেও কম হয়— বলিতে হয়, আত্মঘাতী। অকারণ ভাবেই। প্রসঙ্গটি তিনি না-ই উঠাইতে পারিতেন। প্রসঙ্গ উঠিলে পরিহার করিয়া যাইতে পারিতেন। প্রকাশ্যে আর এক বার কংগ্রেসের দায় স্বীকার করিয়া নিজের ও দলের সততা প্রমাণ করিতে পারিতেন। পরিবর্তে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাই খানিক হারাইয়া বসিলেন।

বিরোধীদের সমালোচনার ক্ষেত্রেও বিশ্বাসযোগ্যতার বড় ভূমিকা থাকে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সম্পর্কে রাহুল গাঁধী তিক্ত মন্তব্য করিবেন, তাহাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাই বলিয়া মুসলিম ব্রাদারহুডের সহিত তুলনা টানিবার প্রয়োজন ছিল না। গোলমেলে তুলনাটির কারণে দেশে প্রভূত আক্রান্ত হইবার পর দিন তিনি পুনর্ব্যাখ্যা করিলেন, তুলনাটি কতখানি যুক্তিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে বলিতে হয়: যুক্তি যাহাই থাকুক, যে কোনও বিচক্ষণ রাজনীতিক জানেন, এ ধরনের তুলনা যত কম করা যায় ততই মঙ্গল। মিশর ও ভারতের বাস্তবের অনেক যোজন দূরত্ব, চরমবাদী সংগঠনগুলির মধ্যেও চরিত্রে ও কার্যবিধিতে বহু পার্থক্য। আরএসএস-এর নিজস্ব আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতেই তাহার মতবাদকে আক্রমণ করা চলে, অকারণ উপমা কেবল বিষয়টিকে গুলাইয়া দেয়।

বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিষয়ে রাহুল গাঁধীর বক্তব্যটিকেও শোভন বলা চলে না। এ ক্ষেত্রে তিনি হয়তো ভুল কিছু বলেন নাই, কিন্তু বিদেশের মাটিতে দাঁড়াইয়া দেশের সম্মুখ সারির মন্ত্রীর নাম তুলিয়া এমন বাক্য শোভনতার সীমা অতিক্রম করে। রাহুল-প্রেমীরা বলিতে পারেন, নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে বিদেশের মাটিতে দেশের বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালান, রাহুল তাহারই যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়াছেন, অশোভনতার অস্ত্রেই অশোভনতার মোকাবিলা করিয়াছেন। তাঁহাদের প্রতি নিবেদন, রাহুল গাঁধীই এ ক্ষেত্রে রাহুল গাঁধীর সর্বপ্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। এত দিন নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির সমস্ত কুৎসা ও আক্রমণের বিপরীতে রাহুল অসাধারণ সংযত ও শোভন রাজনীতির নিদর্শন দেখাইয়াছেন। এমনকি সর্বসমক্ষে দলের সমর্থক ও নেতাদের নীচ রাজনীতি না করিতে আবেদন করিয়াছেন। যে তারে তিনি বিরোধী রাজনীতিকে বাঁধিতে চাহিয়াছেন, তাহা নেহরু-রাজনীতি ধারার যোগ্য উত্তরাধিকার। রাজনীতি-চর্যার সেই উচ্চতম তল হইতে তাঁহার এ বারের প্রতিসরণটি দুর্ভাগ্যজনক। তাঁহার ভ্রান্তি কেবল তাঁহার একার নয়, বিরোধী রাজনীতিরও কিছু ক্ষতি করিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rahul Gandhi London India Congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE