Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

সম্ভাবনার শিল্প

চার বৎসর আগে ক্ষমতায় আসীন হইবার পর হইতে বিজেপির মজ্জায় মজ্জায় আত্মশ্লাঘার প্রবাহ ছাড়া আর কোনও আবেগই দেখা যায় নাই।

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৮ ০০:২৭
Share: Save:

পনেরো আসনের মধ্যে মাত্র দুইটি— নরেন্দ্র মোদীর বিনিদ্র রজনীর কি এই সবে শুরু? গোরক্ষপুর ও ফুলপুরে উপনির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের পর যাঁহারা বলিয়াছিলেন, বিক্ষিপ্ত স্থানীয় ভোটে অমন হইয়াই থাকে, উহা লইয়া ভাবিবার দরকার নাই, এ বার কিন্তু তাঁহারা বলিবার মতো যুক্তি এখনও হাতড়াইয়া বেড়াইতেছেন। কেননা যে চারটি লোকসভা আসন এবং এগারোটি বিধানসভা আসনে বিজেপির মুখ কালো হইল, সেগুলি কোনও বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নহে। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি মিলাইয়া বিবিধের মাঝে এই যে বিরোধী পক্ষের সফল মিলনটিকে দেখা গেল, কোনও মতেই তাহাকে স্থানীয় কিংবা বিক্ষিপ্ত বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। একটি চাল টিপিলেই ভাত হইল কি না বোঝা না-ও যাইতে পারে, কিন্তু অনেকগুলি চাল টিপিয়া দেখিবার পরে? সুতরাং, বিজেপি নেতৃত্বের রজনী বিনিদ্র হইবার যথেষ্ট হেতু রহিয়াছে। বিরোধীদের এক এক করিয়া তাঁহারা উড়াইয়া দিতে পারেন, কিন্তু বিরোধীরা এককাট্টা হইলে সর্বনাশ। এবং অমিত শাহের বাহিনী এ বার বুঝিতেছে, বিরোধীদের এককাট্টা হওয়ার সম্ভাবনাকে যতটা অবাস্তব ভাবা হইতেছিল, ততটা নয়। রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্পকর্ম। কে কী ভাবে যে সেই শিল্পকর্ম রচিয়া ফেলিবেন, শাসক দলের নেতারা হয়তো সেই হদিসটিও সব সময় পান না।

চার বৎসর আগে ক্ষমতায় আসীন হইবার পর হইতে বিজেপির মজ্জায় মজ্জায় আত্মশ্লাঘার প্রবাহ ছাড়া আর কোনও আবেগই দেখা যায় নাই। এত দিনে যদি সামান্য আত্মবিশ্লেষণের সময় তাঁহারা পান, হয়তো বুঝিতে পারিবেন যে আর সব ভুলিয়া শুধুমাত্র কংগ্রেস-বিদ্বেষ, ধর্মীয় মেরুকরণ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি দিয়া এ দেশে বেশি দিন শাসনদণ্ড কার্যকর রাখা যায় না। বহু-সমাজ-বিশিষ্ট দেশ শাসকের কাছে তাহার অপেক্ষা কিছু বেশি দায়িত্ব দাবি করে। পাকিস্তান নিপাতের হুঙ্কারে রক্তে দোলা লাগানো, মুসলিমদমনের হুজুগ তুলিয়া রামভক্তদের গৈরিক তাণ্ডবে নাচানো, এই সব কিছুই ক্রমাগত ব্যবহারে অকেজো ও নির্বিষ হইয়া পড়ে। নয়তো দিল্লির সন্নিকটে, হিন্দুত্ব-প্রতাপবলয়ের অন্দরমহলে, নরেন্দ্র মোদী এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের নামে ভোট-ভাষণ দিয়া আসিলেন, তাহার পরও কৈরানায় এমন বিপুল হার?

নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহকে বিনিদ্র করিয়াছেন ভাবিয়া বিরোধীরা সুখে নিদ্রা যাইবেন, সেই অবকাশও কিন্তু নাই। বরং এই উপনির্বাচন দেখাইয়া দিল যে, বিরোধী নেতৃত্বের উপর এখন কত বড় দায়িত্ব ন্যস্ত রহিয়াছে। উপনির্বাচনের সময় বহু ক্ষেত্রেই স্থানীয় বিষয়গুলি প্রাধান্য পায়। বিভিন্ন দলের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াও সহজতর হয়। জাতীয় স্তরে এখনও বিরোধী দলনেতাদের মধ্যে ঐকমত্যের জায়গাগুলি রীতিমতো অস্পষ্ট, এমনকী কাহার কী ভূমিকা, তাহা লইয়াও সংঘর্ষ প্রবল। অথচ বিরোধী বোঝাপড়ার অর্থই হইল, ক্ষুদ্র স্বার্থবোধ কমাইয়া বৃহৎ স্বার্থের দিকটি দেখা। কত জন নেতানেত্রী তাহাতে আগ্রহী হইবেন, আসল প্রশ্ন তাহাই। একটি বিষয় অবশ্য ক্রমশই পরিষ্কার। কংগ্রেসকে বাদ দিয়া বিজেপি-বিরোধী বৃহৎ বোঝাপড়াটি সফল হইবার সম্ভাবনা নাই, কেননা একমাত্র কংগ্রেসের গায়েই আঞ্চলিকতার অভ্রান্ত ছাপটি লাগিয়া নাই বলিয়া সকলকে টানিয়া রাখিবার ক্ষমতা তাহারই সর্বাধিক। বিরোধী নেতাদের মনে রাখিতে হবে, দেশের নানা অঞ্চলে শাসকবিরোধিতার পরিসরটি সামাজিক ভাবে তৈরি হইয়া গিয়াছে। এখন সেই বিরোধিতার রাজনৈতিক পরিসরটি কত দূর নির্মাণ করা যাইবে, তাহা নির্ভর করিতেছে বিরোধী নেতৃত্বের বিবেচনাবোধের উপর। সম্ভাবনার শিল্পকর্ম রচনা সহজ কাজ নহে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anti-ruling party Third Front BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE