Advertisement
০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

মেরুদণ্ডের আশায়

পরবর্তী অধ্যায়ে সেই আশঙ্কা তীব্রতর হইয়াছে, কারণ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উপর বিভিন্ন বিষয়ে জোর করিয়া সরকারি মত চাপাইয়া দিবার চেষ্টা প্রকট হইয়াছে, আরবিআই আইনের অভূতপূর্ব ব্যবহারেও দিল্লীশ্বররা পিছপা হন নাই।

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:২৩
Share: Save:

ভারতের রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের আসন হইতে উর্জিত পটেলের বিদায়ের সংবাদ শুনিয়াই তাঁহার পূর্বসূরি রঘুরাম রাজন মন্তব্য করিয়াছিলেন, ইহাতে ভারতবাসীর উদ্বেগের কারণ আছে। উদ্বেগের সূক্ষ্মতর— এবং তীব্রতর— সঙ্কেত ছিল মনমোহন সিংহের সুচিন্তিত বিবৃতিতেও। শক্তিকান্ত দাস শূন্যস্থান পূরণ করিবার পরে সেই উদ্বেগ কমিবে, তাহার ভরসা কম। শ্রীদাস যে কাজের ভার পাইয়াছেন তাহার উপযোগী প্রজ্ঞা ও দক্ষতা তাঁহার আছে কি না, অধিকাংশ পূর্বসূরির তুলনায় তাঁহার ‘প্রামাণ্য যোগ্যতা’ অনেকখানি কম কি না, সেই স্বাভাবিক প্রশ্নগুলি ঊহ্য থাকুক। কিন্তু একটি মৌলিক সংশয় অনিবার্য। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীন ভাবে কাজ করিবার অবকাশ আর থাকিবে কি না, সেই সংশয়। রঘুরাম রাজনের মতো যোগ্য আধিকারিককে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব সামলাইবার সুযোগ না দিয়া নরেন্দ্র মোদীর সরকার যখন উর্জিত পটেলকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের চালকের আসনে বসায়, তখনই প্রবল আশঙ্কা দেখা দিয়াছিল যে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা হরণই গূঢ় লক্ষ্য। পরবর্তী অধ্যায়ে সেই আশঙ্কা তীব্রতর হইয়াছে, কারণ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উপর বিভিন্ন বিষয়ে জোর করিয়া সরকারি মত চাপাইয়া দিবার চেষ্টা প্রকট হইয়াছে, আরবিআই আইনের অভূতপূর্ব ব্যবহারেও দিল্লীশ্বররা পিছপা হন নাই।

কিন্তু, দৃশ্যত এই আতিশয্যের তাড়নাতেই, ক্রমশ দিকে দিকে বার্তা রটিয়া গেল যে, ‘কাছের মানুষ’ উর্জিত পটেলও প্রধানমন্ত্রী বা তাঁহার পারিষদদের যথেষ্ট অনুগত নহেন, তাঁহার নিকট রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাতন্ত্র্য ও স্বক্ষমতা মূল্যবান, সেই স্বাধিকার তিনি ষোলো আনা বিকাইয়া দিতে নারাজ। আত্মমর্যাদা, বোধ করি, সম্পূর্ণ বিক্রয়যোগ্য নহে। শক্তিকান্ত দাসের ক্ষেত্রেও এই সত্য পুনরাবৃত্ত হইবে কি না, তিনিও আপন আসনটির (এবং আপনার) মর্যাদা রাখিতে মেরুদণ্ড সোজা রাখিয়া চলিবেন কি না, তাহা জল্পনার বিষয়। আপাতত হাতে রহিয়াছে তাঁহার পূর্বাশ্রমের কাহিনি। সেই কাহিনি নোট-বাতিলের অনুষঙ্গে চিহ্নিত, এবং মোটা দাগে। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর ‘মিত্রোঁ’ সম্বোধনে ভয়ানক বার্তাটি প্রচারিত হইবার পরে অর্থ মন্ত্রকের সচিব হিসাবে শক্তিকান্ত দাসই আসমুদ্রহিমাচল মিত্রদের সম্মুখে অবতীর্ণ হইয়া এক দিকে নোট বাতিলের গুণকীর্তন ও অন্য দিকে এই সিদ্ধান্তের অনুসারী নিত্যনূতন বিধান ঘোষণা করিতেন, যে বিধানগুলি এক দিশাহারা সরকারের হঠকারিতার সূচক হিসাবে কুখ্যাত হইয়াছে, নাগরিকদের উত্তরোত্তর বিপন্নও করিয়াছে। এই অতুলনীয় অ-ব্যবস্থার দায় হয়তো তাঁহার নহে, কিন্তু এই ইতিহাস যদি নাগরিকদের চোখে তাঁহার একটি ‘সকলই তোমারই ইচ্ছা’ ধাঁচের ভাবমূর্তিকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া থাকে, তাঁহাদের দোষ দেওয়া শক্ত।

শীর্ষাসনে বসিয়া তাঁহার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে শক্তিকান্ত দাস ঘোষণা করিয়াছেন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের স্বশাসনের অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া তিনি মনে করেন। কথা ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকিবে তো? এই সংশয়ের বিশেষ কারণ, কেন্দ্রীয় সরকার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ‘উদ্বৃত্ত’ তহবিল হইতে বাড়তি টাকা চাহিতেছে। অনুমান, নির্বাচনের আগে জনমোহিনী ব্যয় বরাদ্দ করিয়া ঘাটতি সামাল দিবার অভিপ্রায়েই এই উদ্যোগ। মনমোহন সিংহ ‘আশা’ প্রকাশ করিয়াছেন যে, শেষ অবধি এই সংশয় সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইবে না। এই আশা চরিতার্থ হইবে কি না, তাহা জানিবার জন্য আপাতত নাগরিকরা শক্তিকান্ত দাসের প্রতি নজর রাখিবেন। কথিত আছে, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। সুতরাং ভারতবাসী এই আশায় বুক বাঁধিবেন যে, নূতন গভর্নর সমস্ত শঙ্কা ও উদ্বেগ ভুলাইয়া প্রমাণ করিয়া দিবেন যে, তিনি সত্যই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের স্বক্ষমতা অক্ষত রাখিতে আগ্রহী। আপাতত আশাটুকুই সম্বল।

অন্য বিষয়গুলি:

RBI Reserve Bank Of India Urjit Patel Shaktikanta Das
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy