Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বিপর্যয়ের কার্যকারণ

কলিকাতার ব্যস্ততম অংশে, গৃহস্থ এলাকার একটি বাড়িতে এমন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক রাখা হইয়াছে, এই সংবাদে শিরদাঁড়া দিয়া হিমস্রোত নামিতে বাধ্য।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আগুন লাগার পর নেভানোর চেষ্টা দমকল কর্মীদের।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আগুন লাগার পর নেভানোর চেষ্টা দমকল কর্মীদের।

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১৫
Share: Save:

পর পর বিপর্যয় ঘটিয়া গেল রাজ্যে। মাঝেরহাট সেতু ভাঙিয়া পড়িবার ক্ষত না সারিতেই বাগড়ি মার্কেট ভস্মীভূত হইল। অগ্নিকাণ্ড ঘটিল মেডিক্যাল কলেজেও। উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের একটি স্কুলে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হইয়া দুই ছাত্রের মৃত্যু হইল, এবং তাহার আঘাত প্রশমিত না হইতেই কলিকাতার নাগেরবাজারে বোমা ফাটিয়া এক স্কুলছাত্র প্রাণ হারাইল। এই সকল অপ্রত্যাশিত আঘাতের সঙ্গে নিয়ত ঘটিয়া চলিয়াছে প্রত্যাশিত বিপর্যয়, ডেঙ্গিতে মৃত্যু। আপাতদৃষ্টিতে এই সকল ঘটনা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। সত্যই কি তাই? অপ্রতিরোধ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অভাবনীয় সঙ্কট উপস্থিত হওয়ার জন্য কি এগুলির কোনওটি ঘটিয়াছে? না। এমন যে ঘটিতে পারে, তাহার ইঙ্গিত বহু পূর্বেই ছিল। মাঝেরহাট সেতু যে দুর্বল ও বিপজ্জনক হইয়া রহিয়াছে, এমনকি আরও অনেকগুলি সেতুই যে এমনই দুর্দশাগ্রস্ত, তাহা সরকারের অজানা নহে। বর্ষার জল জমিলে মশা বংশবৃদ্ধি করিবে এবং ডেঙ্গি ফিরিয়া আসিবে, তাহাও জানা। কলিকাতার পুরাতন বাজারগুলি যে জতুগৃহ, সুরক্ষার কোনও নিয়মই সেখানে বলবৎ নাই, নন্দরাম মার্কেট তাহা দেখাইয়াছিল দশ বৎসর পূর্বে। হাসপাতালের অবস্থাও তথৈবচ, সাত বৎসর পূর্বে দেখাইয়াছে দক্ষিণ কলিকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতাল। ছাত্রদের দাবি অস্বীকার করিলে ইসলামপুরের স্কুলটিতে সংঘাত বাধিতে পারে, তাহারও আগাম খবর ছিল। অতএব প্রশাসন তৎপর হইবার, কঠোর হইয়া নিয়ম বলবৎ করিবার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পাইয়াছিল। কোনও ক্ষেত্রেই তাহা করে নাই। গণতন্ত্রে জনগণের সহিত প্রশাসনের ভারপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধির যে চুক্তি, তাহা সর্বপ্রকারে লঙ্ঘিত হইয়াছে। নাগরিকের প্রাণ ও সম্পত্তির সুরক্ষা সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। সাম্প্রতিক বিপর্যয়গুলির প্রতিটি দেখাইয়া দিল, সরকার সেই দায়িত্বকে গুরুত্ব দেয় নাই।

নাগেরবাজারের ঘটনাটি ধরা যাক। বসতবাড়িতে মারাত্মক বিস্ফোরক মজুত রাখিবার সংবাদ ইতিপূর্বে আসে নাই, এমন নহে। কিন্তু তাহা প্রধানত গ্রামে। কলিকাতার ব্যস্ততম অংশে, গৃহস্থ এলাকার একটি বাড়িতে এমন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক রাখা হইয়াছে, এই সংবাদে শিরদাঁড়া দিয়া হিমস্রোত নামিতে বাধ্য। বর্ধমানের খাগড়াগড় কাণ্ডে স্থানীয় মানুষ যে আতঙ্কগ্রস্ত হইয়াছিলেন, তাহা কেবল বিস্ফোরণের তীব্রতায় নহে। তাহার কারণ, পুলিশ-প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়া দৈনন্দিন গৃহস্থজীবনের একেবারে অভ্যন্তরে প্রবেশ করিবার প্রকল্পে দুর্বৃত্তদের সাফল্য। ইহা কি নিতান্ত অরাজকতারই প্রমাণ নহে?

এহ বাহ্য। নাগেরবাজারে তদন্তের নামে যাহা ঘটিতেছে, তাহাতে ক্ষোভ পরিণত হইতেছে আতঙ্কে। ফরেনসিক দল আসিবার পূর্বেই বিস্ফোরণ স্থল ধুইয়া মুছিয়া সাফ করা হইয়াছে। বিস্ফোরকের নমুনা-সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ উধাও হইয়াছে। পুলিশ এবং পুরসভার কর্তব্যপরায়ণতা দেখিয়া নির্বাক হইতে হয়। কিংবা হয়তো বিস্ময়ের কিছু নাই। মাঝেরহাট হইতে নাগেরবাজার, সর্বত্রই বিপর্যয়ের পর তদন্তের ছবি প্রায় এক। প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা অনুসন্ধানের পূর্বেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছেন। ‘অপরাধী’ কখনও রেল কর্তৃপক্ষ, কখনও বিরোধী রাজনৈতিক দল, কখনও স্বয়ং নাগরিক (তাঁহারা জল জমাইয়া মশার চাষ করেন)। কিন্তু দায়প্রাপ্ত মন্ত্রী, সরকারি আধিকারিক কিংবা পুলিশ কখনওই সন্দেহভাজনের তালিকায় নাই। সচরাচর ক্ষতিগ্রস্তকে চাকরি ও অর্থ দিয়া ন্যায়বিচার পর্ব সমাধা হইয়া থাকে। সত্য কী, তাহার হদিস মিলে না। এমনকি সত্য জানিতে চাহিলে, প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি দাবি করিলে, বিরোধী বলিয়া চিহ্নিত হইতে হয়। ইসলামপুরে নিহত দুই ছাত্রের মায়ের বিচারের আবেদন যে রাজনৈতিক দাবি হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা আকস্মিক নহে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE