Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

আশঙ্কাময় সংস্কার

এত দিন ইউজিসি-র হাতে কোনও প্রতিষ্ঠানের মান নির্ণয় এবং অর্থসাহায্য দান বিষয়ক দু’টি সিদ্ধান্তই ন্যস্ত ছিল বলিয়া দুর্নীতির নিহিত ও প্রকৃত সুযোগও ছিল মস্ত।

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৮ ০০:৪১
Share: Save:

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সংস্কার যে অত্যন্ত জরুরি হইয়া পড়িয়াছিল, সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিবেন। তবে এই ‘সকল’-এর মধ্যে অতি-সরকারবাদীরাও পড়েন, পড়েন শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধবাদীরাও। ১৯৫৬ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইনের মাধ্যমে এই সংস্থাটি তৈরি হয়, তখন ভাবা হইয়াছিল সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইহা একটি সেতুর কাজ করিবে। গত কয়েক দশকে সেই সেতুবন্ধন কতখানি সম্ভব হইয়াছে, যতখানি হইয়াছে তাহা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কি না, এ সব বিষয়ে বহু বিতর্ক থাকিলেও একটি বিষয় কিন্তু বিতর্কোর্ধ্ব: ভারতের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্র এই মুহূর্তে গুরুতর পীড়াগ্রস্ত, ধারাবাহিক ভাবে তাহার অবস্থার (মানের) অবনতি ঘটিতেছে, আশু নিরাময় দরকার। অথচ ‘নিরাময়’-এর অভীপ্সায় বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যখন ঘোষণা করিল যে অতঃপর ইউজিসি আর থাকিবে না, পরিবর্তে হায়ার এডুকেশন কমিশন অব ইন্ডিয়া (এইচইসিআই) গঠিত হইবে, তখন বুঝিতে পারা গেল না যে, সংস্কারের আর্তিটি কোন দিক হইতে আসিতেছে, সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমাইবার লক্ষ্যে না কি সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করিবার উদ্দেশ্যে। এমন একটি মৌলিক সংশয়ের অবকাশ যে থাকিতেছে, তাহা বিরাট দুর্ভাগ্যের কথা। অনেক দিন পর ইউজিসি-র আকাঙ্ক্ষিত সংস্কারে অনেকেই আশা করিয়াছিলেন যে, পরিবর্তনের ফলাফল হিসাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি স্বাধীনতা পাইবে, তাহাদের নিজ নিজ দুর্বলতা মোচনের চেষ্টা করিবে। তাহা হইল না। বরং সাম্প্রতিক এইচইসিআই প্রস্তাবনার বিশ্লেষণ বলিতেছে, কোনও স্বাধীনতা প্রদানের আঁচ ইহাতে নাই।

যেমন, এত দিন ইউজিসি-র হাতে কোনও প্রতিষ্ঠানের মান নির্ণয় এবং অর্থসাহায্য দান বিষয়ক দু’টি সিদ্ধান্তই ন্যস্ত ছিল বলিয়া দুর্নীতির নিহিত ও প্রকৃত সুযোগও ছিল মস্ত। সেই অভিযোগের নিরাময়ার্থে এবারকার প্রস্তাব: নূতন সংস্থার হাতে কোনও আর্থিক সিদ্ধান্ত ছাড়া হইবে না, আর্থিক বণ্টনের অধিকার থাকিবে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের এক্তিয়ারে। উদ্বেগজনক। কেন্দ্রীয় মন্ত্রকই যদি অর্থ বণ্টনের অধিকার সরাসরি নিজের হাতে রাখে, তবে আর সংস্কার আইনের প্রাথমিক খসড়ায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বশাসন’ শব্দবন্ধ রাখিবার অর্থ কী? ফান্ড বণ্টনের নামে ইউজিসি অতিরিক্ত আইনি ফাঁসে প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাঁধিয়াছিল ঠিকই, কিন্তু সেই একই কাজ যে এখন মন্ত্রকের তরফেও ঘটিবে না, তাহারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? শিক্ষা-উৎকর্ষই যে বিচারের একমাত্র মানদণ্ড হইবে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতা রক্ষা নিশ্চিত হইবে কী উপায়ে?

আসলে, নূতন আইনের খসড়া করিতেছেন যাঁহারা, একটি মৌলিক বিষয় তাঁহারা মাথায় রাখেন নাই। সন্দেহ হয়, সচেতন ভাবেই রাখেন নাই। তাহা হইল: উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি ঠিক আর পাঁচটি শিল্পক্ষেত্রের মতো নহে যে, সেবি-জাতীয় একটিমাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা দিয়াই তাহার সামগ্রিক দেখভাল সম্ভব। আবার, পুরা বেসরকারি ক্ষেত্রের সহিতও ইহার তুলনা চলে না, কেননা শেষ বিচারে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকে এগোনোও নিশ্চয় উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রের একটি অঘোষিত দায়। এই পরিস্থিতিতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার রূপটি হওয়া উচিত আলগা ছত্রচ্ছায়ার মতো, যেখানে কতকগুলি বৃহত্তর রূপরেখার বৃত্তে অনেকখানি স্বশাসন ও স্বাধীনতার পরিসর থাকিবে। এইচইসিআই যে ভাবিতেছে, কেবলমাত্র ‘সারস্বত’ বিষয়গুলি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করিলেই ভারতীয় উচ্চশিক্ষার অসুখ সারানো যাইবে, তাহা অলীক ভাবনামাত্র। সরকারি ‘নিয়ন্ত্রণ’ সারস্বত উৎকর্ষের পক্ষে শুভ হইতে পারে না, সহায়ক তো নয়ই। সুতরাং প্রকাশ জাভড়েকরদের পরিকল্পনায় আশঙ্কার বিরাট অবকাশ রহিয়া গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Reformation UGC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE