Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
অস্ত্র হননেচ্ছা জাগিয়ে তোলে, বিশেষ করে বয়স যদি কম হয়

এ কোন রাম, কাদের রাম?

বাঙালি রাম নিয়ে তেমন মাতামাতি না করলেও উত্তর ভারতে রামের জনপ্রিয়তা কিংবা মহিমা এতটাই ব্যাপক যে, তাঁকে একচ্ছত্র বললে বাড়াবাড়ি হয় না।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

আশির দশকে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখতে আমাকে রামের বনবাসের পথটি পরিক্রমা করতে যেতে হয়েছিল। দেড় মাসের ওই পরিক্রমায় আমি অযোধ্যা থেকে শুরু করে রামেশ্বরম পর্যন্ত পরিভ্রমণ করি। রামচন্দ্র বাংলা রাজ্যে তেমন চর্চিত পুরুষ নন। এখানে রামনবমীও তেমন ঘটা করে পালিত হয়নি কখনও। তা বলে বাঙালি রামকে উপেক্ষার চোখে দেখে, এমনও নয়। কৃত্তিবাসী রামায়ণ একসময়ে ঘরে ঘরে পড়া হয়েছে। তবু এ রাজ্যে দুর্গা বা কালী, শিব কিংবা কৃষ্ণের মতো রামচন্দ্র পূজিত হননি। আমার মনে হয় বাঙালির চোখে রামচন্দ্র বোধ হয় তেমন বর্ণময় বলে প্রতিভাত নন। পরিক্রমার সময় আমি প্রায় দিনরাত রামায়ণে ডুবে থাকতাম। তখন রামচন্দ্রের চরিত্র আমাকে এক গভীর সম্মোহনে আবিষ্ট করে। বীর বলে নয়, রাম এক অদ্ভুত মানবিক পুরুষ। ক্ষমায়, দয়ায়, কারুণ্যে যেন এক গলিত অহং-এর ফলিত প্রকাশ।

বাঙালি রাম নিয়ে তেমন মাতামাতি না করলেও উত্তর ভারতে রামের জনপ্রিয়তা কিংবা মহিমা এতটাই ব্যাপক যে, তাঁকে একচ্ছত্র বললে বাড়াবাড়ি হয় না। আর রামের অনুষঙ্গে অবশ্যম্ভাবী যাঁর নাম উচ্চারিত হয় তিনি তুলসীদাস। গোটা উত্তর ভারতে রামকথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। রামচরিতমানসের মতো বেস্টসেলার আর কোনও ভারতীয় বই আছে বলে আমার মনে হয় না। পথের ধারে ফুটপাত থেকে বড়সড় দোকান,সর্বত্র তুলসীদাস গোসাঁইয়ের রামচরিতমানস সহজতম লভ্য। আমিও একখানা সস্তা এডিশন কিনে সঙ্গে রাখতাম, হিন্দি ভাল না জানলেও পড়ার চেষ্টা ছিল।

রিকশাওয়ালা, বাস কন্ডাক্টর, হোটেলের পরিচারক, পথচলতি মানুষ যার সঙ্গেই কথা বলেছি, সবাই দেখেছি রামচরিতমানস থেকে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি মুখস্থ বলে যেতে পারে। একখানা বইয়ের এই বিপুল জনপ্রিয়তা অবিশ্বাস্য। বাল্মীকির রামায়ণ ছাড়াও বিস্তর রামায়ণের কথা শোনা যায়। এমনকী জাভা সুমাত্রায়ও রামায়ণের নানা সংস্করণ পাওয়া যায়। কিন্তু তুলসীর রামায়ণের মতো এত পঠিত বোধ হয় কোনওটাই নয়। আর তুলসী তাঁর রামকথায় রামকে শুধু বীর বানাতে যাননি, রাম কেন পুরুষোত্তম তাই তাঁর মরমি বিবরণে বর্ণিত হয়েছে। যুদ্ধবিগ্রহ আছে বটে, তবে রামায়ণকে আমার কখনওই বীরগাথা বলে মনে হয়নি। মধুসূদনও চেয়েছিলেন ‘গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত’ এবং সে বাবদে মায়ের কাছে তাঁর প্রার্থনাও ছিল ‘...দাসে দেহ পদচ্ছায়া’। কিন্তু শেষ অবধি রামকাহিনিতে বীররসের সঞ্চার তিনিও ঘটাতে পারেননি। মেঘনাদবধ হয়ে উঠল এক অসামান্য করুণ রসের কাব্য, যা পড়ে আজও আমাদের বুক ভারী হয়।

তাই খটকা লাগে রামনবমীতে সশস্ত্র মিছিলের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। আমি অযোধ্যায় আমার পরিক্রমা শুরু করেছিলাম রামনবমীর আগের দিন থেকে। চার পাঁচ দিন অযোধ্যায় অবস্থানকালে আমি কোনও সশস্ত্র মিছিল দেখিনি। বস্তুত কারও হাতেই কোনও অস্ত্র শোভা পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। রামকে তো কেউ বীর বলে ভজনা করে না। তাঁকে স্মরণ করা হয় একজন মহা ত্যাগী, কাম ও লোভহীন, মোহমুক্ত, সমদর্শী, উচ্চকোটির পুরুষ হিসাবে। সেই সঙ্গে অসামান্য প্রশাসক ও দরদি, ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ হিসাবে।

রামরাজ্য বলতে তো আমরা বুঝি এক সুশাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় শান্তি ও শৃঙ্খলায় নিষ্পন্ন জীবনধারা। অস্ত্রধারণ করবে রাষ্ট্রের রক্ষকরা। সবাই অস্ত্র ধরলে অরাজকতা অবধারিত। কারণ অস্ত্র নিজেই এক প্ররোচনা। হাতে নিলেই নিজেকে অযথা শক্তিমান বলে মনে হতে থাকে। অস্ত্র হননেচ্ছা জাগিয়ে তোলে, বিশেষ করে বয়স যদি কম হয়। যাঁরা বালক বা কিশোরদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন তাঁরা পরোক্ষে তাদের ভিতরকার হিংস্রতাকেই জাগিয়ে তুলছেন। তা হলে আর দুনিয়া জুড়ে নিরস্ত্রীকরণের ধুয়া তুলে লাভ কী? এখন এক বিপন্ন সময়। এখন বিপুল অস্ত্র পকেটে পকেটে ঘুরছে। অতি তুচ্ছ কারণে পড়ছে লাশ। এখন তো অস্ত্র সংবরণ করাই আমাদের যাজন হওয়া উচিত।

এ-যুগের রাজনীতির আঁচ এই পুরাণপুরুষকে স্পর্শ করলে সেটা আমার মতো রাম-অনুরাগীদের একটু ধাঁধায় ফেলে দেয়। মনে হয় আমরা কি এত ভুল বুঝলাম! শুধু আমি কেন, সারা দেশের রামভক্তরাই কি স্বস্তি বোধ করবেন! আমি যে কত লোককে দেখেছি রামের দয়ার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন।

খবরের কাগজে পড়ছি, টিভিতেও দেখছি রামনবমীর মিছিলে বড়দের সঙ্গে ছোটদেরও অস্ত্র হাতে শামিল করা হয়েছে। রামের মতো একজন স্নিগ্ধ পুরুষের স্মরণে যে সশস্ত্র আস্ফালন কতটা বেমানান তা কি ব্যাখ্যা করার দরকার আছে?

রামকে প্রয়োজনে অস্ত্রধারণ করতে হয়েছে, অনন্যোপায় হয়ে শত্রুবধও করতে হয়েছে, তবু তিনি পুরাণখ্যাত অন্য বীরদের সঙ্গে তুলনীয় নন। অস্ত্রধারী রামকে বরং একটু অচেনাই মনে হয়। আজ যদি এতকাল পরে বঙ্গভূমিতে রামচন্দ্রকে স্মরণ করার দরকার দেখা দিয়েই থাকে তা হলে এতকাল যে ভাবে ভাবে-ভক্তিতে স্মরণ করা হয়েছে সে ভাবেই হোক। রণং দেহি মূর্তিতে কেন? আর সেই আস্ফালনে ছোটোদের শামিল করার অর্থ কি তাদের মধ্যে হিংস্রতার বীজ বপন করে দেওয়া? তাতে লাভ কী? এতে তো আমাদেরই ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে।

অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়েই বিরাগের প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। গতকালও অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কে মিছিলে শামিল হয়েছেন বিটল গায়ক পল ম্যাকার্টনি। তাঁর বন্ধু জন লেননকে বহু বছর আগে হত্যা করেছিল এক বন্দুকবাজ। বস্তুত অস্ত্র এখন আমাদের সব চেয়ে অপছন্দের জিনিস। ধর্মের স্মারক হিসাবে যদি একান্তই কোনও অস্ত্র ধারণ করতে হয় তবে তা বিপজ্জনক না হয়ে আলংকারিক হওয়াই ভাল। আর শিশু বা কিশোরদের এতে শামিল করা বিবেকহীন অদূরদর্শিতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE