পথ দুর্ঘটনা বাড়িতেছে কলিকাতার বুকে। শহর জুড়িয়া উড়ালপুলের বাড়বাড়ন্ত, উন্নততর সিগন্যাল ব্যবস্থা, পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন— কোনও কিছুই তাহাতে যথেষ্ট রাশ টানিতে পারিতেছে না। কারণ একাধিক। একটি বড় কারণ যাত্রী তুলিবার জন্য বেসরকারি বাসগুলির রেষারেষি। অধিক যাত্রী, অর্থাৎ অধিক কমিশন। সেই বাড়তি কমিশনের লোভে একই রুটের বাসগুলি যাত্রী তুলিবার প্রতিযোগিতায় নামে। এবং পরিণামে বিপজ্জনক ভাবে ওভারটেক, সিগন্যাল অমান্য-সহ পথ-আইন ভাঙিবার প্রবণতা বাড়ে। বাসের রেষারেষি বন্ধের যুক্তি হিসাবে তাই দীর্ঘ দিন ধরিয়াই কমিশন প্রথা তুলিয়া দিবার দাবি উঠিতেছিল। সম্প্রতি সেই দাবিকেই মান্যতা দিয়া পরিবহণ দফতর কমিশন প্রথা তুলিয়া দিতে উদ্যোগী হইয়াছে।
এবং বিক্ষোভের মুখে পড়িয়াছে। বাসমালিকদের একাংশের অভিযোগ, কমিশন প্রথা তুলিয়া দিলে পরিষেবা বন্ধ করিতে হইবে। ইহার একাধিক কারণের মধ্যে একটি হইল, রুটের পরিকল্পনায় সামঞ্জস্যের অভাব আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই পথে প্রয়োজনাতিরিক্ত বাস চলাচল করিয়া থাকে। ফলে, বাসপিছু আয় কম। বাসগুলির যাত্রী তুলিবার আগ্রহ এই কারণেই। অভিযোগটি সম্পূর্ণ অসত্য নহে। বাসচালক এবং কন্ডাকটর টাকার হিসাবে যাহা হাতে পাইয়া থাকেন, তাহা নিতান্তই সামান্য। ফলত, উপরি রোজগারের তাড়না সব সময়ই তাঁহাদের মধ্যে কাজ করে। রুট পরিকল্পনায় গলদও বিলক্ষণ আছে। কিন্তু তাহা কখনও কমিশন প্রথার বা রেষারেষির সপক্ষে যুক্তি হইতে পারে না। বিশেষত যে রেষারেষির কারণে প্রায় নিয়মিত প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটিয়া থাকে। কোন রুটে কত বাস দরকার, তাহার সুষ্ঠু পরিকল্পনা চাই সর্বাগ্রে, অথচ সেই বিষয়ে না বাসমালিক, না সরকার, কাহারও কোনও আগ্রহ নাই।
রাজ্যের পরিবহণ ব্যবস্থার এই দুর্দশার জন্য অনেকাংশে দায়ী গণপরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধি না করিবার অবাস্তব প্রয়াস। এই প্রয়াসের বাড়বাড়ন্ত সেই বাম আমল থেকেই। এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে যাঁহারা ধুন্ধুমার তাণ্ডব করিয়াছিলেন, ক্ষমতায় আসিয়া তাঁহারা সেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। তাঁহাদের বিশ্বাস ছিল, ভাড়া বাড়িলে সরকারের জনদরদি ভাবমূর্তিতে কালি লাগিবে। সুতরাং তেলের দাম ও অন্যান্য খরচ যতই রকেট গতিতে আকাশ স্পর্শ করুক না কেন, বাসের ভাড়া বৃদ্ধি গরুর গাড়িকে হার মানায়। অথচ, জনগণের মন রাখিতে ভাড়া বৃদ্ধি না করিবার ধারণাটি যে কতখানি অমূলক, তাহার প্রমাণ— কলিকাতা শহরের রাস্তায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসগুলির ভিড়। স্পষ্টতই, পরিষেবা যথাযথ হইলে নাগরিক কিছু বাড়তি খরচ করিতে প্রস্তুত। নির্দিষ্ট সময় অন্তর তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলাইয়া ভাড়া বাড়িলে বাসগুলির হাল ফিরে, ড্রাইভার-কন্ডাকটরের বেতন ভদ্রস্থ অঙ্কে পৌঁছায়, কমিশনের পশ্চাতে দৌড়াইবার প্রবণতাও কমে। কিন্তু জনমোহিনী রাজনীতি বড় বালাই। তাহাতে নাগরিকের প্রাণ অপেক্ষা ভোটবাক্সের টান বেশি। সেই টান কাটাইতে হইবে। সম্প্রতি সেই সদর্থক পথেই সরকার হাঁটিয়াছে। খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়া ভাড়া কিছু বাড়িয়াছে। কিন্তু তাহা এখনও যথেষ্ট নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy