Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

পথের বিপদ

পার্ক স্ট্রিটের সাম্প্রতিক অবরোধ সেই ধারারই নবতম সংযোজন। এই অঞ্চলের একটি বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ আগামী শিক্ষাবর্ষ হইতে ‘অস্বাভাবিক’ হারে ফি-বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত লওয়ায় অভিভাবকরা কিছুক্ষণের জন্য পথ অবরোধ করিয়াছিলেন।

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৮ ০১:২৭
Share: Save:

কলিকাতা পথে নামিয়াছে। সার্বিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে নহে, পরিবর্তনের দাবিতেও নহে, বরং বহুবিধ খুচরা, প্রায়-ব্যক্তিগত দাবি এবং অভিযোগ সঙ্গে লইয়া। কখনও তাহা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতানৈক্য, কখনও অধ্যক্ষ-উপাচার্যের পদত্যাগ, কখনও আবার রোগীর মৃত্যু, হাসপাতালের গাফিলতি। সংক্ষেপে বলিলে, পথই বর্তমানে কলিকাতার অ-রাজনৈতিক প্রতিবাদের একমাত্র মঞ্চ। যে কোনও দাবি, তাহা যত তুচ্ছই হউক না কেন, পথে নামিয়া, তাহাকে অবরুদ্ধ করিয়া জানাইতে না পারিলে যেন প্রতিকারের আশা নাই। ফলে, পথ তাহার গতি হারাইতেছে। পার্ক স্ট্রিটের সাম্প্রতিক অবরোধ সেই ধারারই নবতম সংযোজন। এই অঞ্চলের একটি বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ আগামী শিক্ষাবর্ষ হইতে ‘অস্বাভাবিক’ হারে ফি-বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত লওয়ায় অভিভাবকরা কিছুক্ষণের জন্য পথ অবরোধ করিয়াছিলেন। কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে ইতিবাচক আশ্বাস পাইবার পর অবরোধ উঠিয়া যায়।

এবং একটি প্রশ্ন রাখিয়া যায়। ফি-বৃদ্ধিজনিত অসন্তোষ কি উভয় পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে দূর করা যাইত না? অভিভাবকদের কাছে এই বৃদ্ধির হার অসঙ্গত মনে হইতে পারে, তাঁহাদের অন্ধকারে রাখিয়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত লইয়া ক্ষোভও থাকিতে পারে। কিন্তু আপত্তি-অভিযোগ জানাইবার কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। তাহা না করিয়া ব্যস্ত সময়ে অন্যদের অসুবিধা ঘটাইয়া জবরদস্তি সমাধানসূত্র খুঁজিবার চেষ্টাটি সুস্থ চিন্তার পরিচায়ক নহে। রাজনীতির ক্ষেত্রে এই চিন্তাধারা ‘রাস্তার রাজনীতি’ হিসাবে হাততালি কুড়াইতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও যদি সাধারণ মানুষ অবিরত রাস্তার রাজনীতির শরণ লয়, তবে বিপদ। রাস্তার রাজনীতি শুধুমাত্র যে রাস্তায় নামিয়া করিতে হয়, তাহা নহে। কথায়-কথায় ঘেরাও, প্রতিষ্ঠান অচল করিয়া রাখাও রাস্তার রাজনীতির মধ্যেই পড়ে। ইহাতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান তো আসেই না, বরং উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাসের জায়গাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা এবং তৎপরবর্তী জনরোষের চিত্র দেখিয়া আশঙ্কা, সেই ক্ষতিটিই হইতেছে। বিশেষত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে ইহা মর্মান্তিক সত্য। অতি সম্প্রতি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস-এর অধ্যক্ষ ছাত্রবিক্ষোভ চলাকালীন পদত্যাগ করিয়াছেন। এমন বিক্ষোভের চিত্র আর বিচ্ছিন্ন নহে। বরং অভিযোগ উঠিলেই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সরব হওয়া, তাঁহার অপসারণ দাবি এবং প্রয়োজনে আইন নিজ হস্তে তুলিয়া লওয়াটাই এখন নিয়ম। দোষ এখানে কোনও এক পক্ষের নহে। কর্তৃপক্ষও তাঁহার ব্যবহারে, নিয়মে, পরিচালনায় এমন কিছু দেখাইতে পারেন নাই, যাহাতে অন্য পক্ষের বিশ্বাস অটুট থাকে, আবার অভিভাবক-পড়ুয়ারাও সব দায় কর্তৃপক্ষের উপর চাপাইয়া, তাঁহার অপসারণেই রোগমুক্তির আশা রাখিতেছেন। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বাসের জায়গাটি বড় গুরুত্বপূর্ণ। ইহাতে আঘাত আসিলে আসল উদ্দেশ্যটিই নষ্ট। তাহাই হইতেছে। নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও পঠনপাঠনের পরিবেশ হারাইতেছে। মেধাবী ছাত্রছাত্রী, যাঁহারা এই রাস্তার রাজনীতিতে উৎসাহী নহেন, অন্যত্র পাড়ি দিতেছেন। অবিলম্বে এই পথ-সংস্কৃতির পরিবর্তন না ঘটিলে রাজ্যের শিক্ষাকাশে আঁধার ঘনাইতে বিলম্ব লাগিবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Road rallies education system
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE