Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

স্লো মোশন ঝকমারি

রথের সঙ্গে যত বিজয়গৌরবই জড়িয়ে থাক, রথ আসলে একটি ল্যাগব্যাগার্নিস। কী করে যে পুরাণকাল থেকে এত মহিমে পেল কে জানে?র থ আমি তেমন করে ঠিক চালাইনি। ছোট থেকেই ভারী অধৈর্য আমি এ ব্যাপারে। তবু দোতলা কিংবা একতলা কাঠের রথ মন ও সাংঘাতিক ক্রিয়েটিভিটি সহযোগে সাজাতাম। ফিনফিনে কাগজের শেকল আর মার্বল পেপার, এই ছিল সম্বল।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৫ ০০:১৫
Share: Save:

র থ আমি তেমন করে ঠিক চালাইনি। ছোট থেকেই ভারী অধৈর্য আমি এ ব্যাপারে। তবু দোতলা কিংবা একতলা কাঠের রথ মন ও সাংঘাতিক ক্রিয়েটিভিটি সহযোগে সাজাতাম। ফিনফিনে কাগজের শেকল আর মার্বল পেপার, এই ছিল সম্বল। ঢেউ খেলানো কিংবা তেকোনা ডিজাইন করে তাতে সযত্নে আঠা লাগিয়ে যেই রথের ওপর লাগাতাম, ঠিক তখুনি আমার হাতের অবশিষ্ট আঠার সঙ্গে ডিজাইন করা মার্বল পেপার উঠে চলে আসত এবং ফ্যাঅ্যাসস শব্দে ছিঁড়ে যেত। নিজের ওপর খুব খানিক রাগ করে ফের কাজে লাগতাম। রাতে মোটামুটি খানিকটা সাজিয়ে শুতে যেতাম। সকাল উঠে অবধারিত দেখতাম মার্বল পেপার কোনও কোনও জায়গা থেকে খুলে ঝুলছে, না হলে অপটু হাতে আঠা লাগানোর জন্য কিছুটা কুঁচকে ফুলে রয়েছে। এ যে কেবল আমার সাজানো ভেস্তে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, তা কি আমি বুঝতাম না? তবু দমব না। আবার সকাল থেকে মেরামত করতে বসতাম। দুপুর নাগাদ সে সব বৃহৎ কর্মকাণ্ড সাঙ্গ হত। বিকেল হতেই আমার অপূর্ব কারুকার্য করা রথে যেই জগন্নাথদেবকে বসিয়ে টানতে শুরু করা, অমনি হয় বলরাম পপাত চ, নয়তো সুভদ্রা অথবা নকুলদানার থালা। গলা ঠেলে কান্না আসত। তবু, সে সব সামলে, রাস্তার লোকজনকে প্রসাদ দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আধঘন্টায় মোড়েও পৌঁছতে পারিনি। ও দিকে পাড়ার বড়রা খানিকটা আমাদের ঠেলে, খানিকটা উপেক্ষা করে রইরই করে চলে গেল হাজরা মোড়ের দিকে। সেখান দিয়ে তখন ইসকনের রথ যাবে।

খুব কদর সেই রথের। বিরাট রথের বারান্দা থেকে প্রসাদ হরিল্লুঠ হবে, আর তা কুড়িয়ে নেওয়া জন্য লোকজনের কী আদেখলাপনা। আমার রথের প্রতি কারও কোনও সম্মান না দেখে এবং এত শ্লথ গতির একটি যান কিছু ক্ষণ চালিয়ে খুব বোর হয়ে, রথের মাথার ডান্ডিটা ধরে খপ করে হাতে উঠিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। তাতে অবশিষ্ট মার্বল পেপারের সজ্জাও একেবারে ছিরকুটে মেরে যেত। বাড়ি ফিরেই মাকে চেপে ধরতাম, ‘একটা রথ কেন খামখা মেন রোড ধরে বেরিয়ে সমস্ত জনজীবন অচল করবে?’ কারণ উক্ত কারণেই আমার রথের প্রতি সবার মনোযোগ চলে গেছে। কাল রাত্তিরে ঘুম-চোখ কচলে, আজ সারা সকাল ঠায় পিঠ সোজা করে অত যে সাজালাম, সে সব কিনা কেউ মান্যি করলে না! জিজ্ঞেস করতাম, ‘আচ্ছা মা, রথের দড়ি টেনে মানুষের কী আনন্দ হয়?’ মা বলত, ‘ছিঃ, এ সব কথা বলতে নেই। যার যাতে বিশ্বাস। কারও বিশ্বাসকে ছোট করতে নেই।’

আসলে আমি তত দিনে রথ যানটার প্রতি বেজায় বিরক্ত হয়ে উঠেছি। একে তো সাজানোর রকমারি ঝামেলা। তার পর যতই সাজাই অন্য কোনও ছেলেমেয়ের আঁকাজোকা শেখা দাদা-দিদিরা ঠিক আমার সাজানোকে বিট করে দিত। ফলে আমার খাটনির তেমন কদর কেউ করত না। তার পর রথ টানা হরেক ঝামেলা, কথায় কথায় উল্টেই যায়, সাধে উল্টোরথ বলেছে? তাই একটু বিজ্ঞের মতো ভাব করে শুধোতাম, ‘আচ্ছা মা, রথের মতো এত স্লো একটা যান চড়ে আগেকার লোকেরা কী করে এত যুদ্ধ করত? যত দূর জানি, যুদ্ধ ব্যাপারটা ধুন্ধুমার ছিল আর তাতে গতির একটা বড় ভূমিকা ছিল।’ মা উত্তর দিত, ‘আহা, ওরা তো ঘোড়া জুড়ে দিত রথের সঙ্গে, মানুষ কি আর সেই রথ টানত?’ উত্তরটা খুব মনে না ধরলেও চুপ করে থাকতাম। রথকে কেমন যেন একটা ভারসাম্যহীন যান মনে হয়। কথা না বাড়িয়ে তখুনি রথের মেলা যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম। কিছুতেই নিয়ে যাওয়া হত না। বাহানা থাকত— হয় ঝিপঝিপ বৃষ্টি, না হলে পিষে যাওয়া ভিড়।

এর পর টিভিতে ‘মহাভারত’ সিরিয়াল শুরু হল, তাতে সোনালি কাগজ সাঁটা রথ দেখে তো আমি যার পর নাই স্তম্ভিত হলাম— এ রকম একটা অস্বস্তিকর যানে চড়ে কোনও লোক কী করে এত জরুরি কাজ করতে যায়? বসার জায়গা পায়? না কি, এটা আসলে অস্ত্র রাখার মিনি আলমারি? কীসের সুবিধের জন্য এত নড়বড়ে একটা যান এত জরুরি? তার চেয়ে এমনি ঘোড়ায় করে যা না বাপু। তোরও কষ্ট কম, তোর ঘোড়াগুলোরও। মা বলত, এ সব ঠিক কথা নয়, রথের অমর্যাদা করা উচিত নয় মোটেও।

খুব মেনে নিতাম না। কারণ আমি এখনও মনে করি, বেচারা কর্ণ স্রেফ একটা অস্বস্তিকর যানের জন্যই প্রাণ হারিয়েছিল। নিয়তিটিয়তি সব বাজে কথা। অভিশাপ দিলেই যদি রথের চাকা বসে যেত তা হলে ট্রাফিক পুলিশরা রোজ যত জনকে অভিশাপ দেয়, তাতে গাড়ি আর কোনও দিন চলত না রাস্তায়। আর কর্ণ লোকটাই বা কীরকম বেআক্কেলে! রথের চাকা তোলা জরুরি না যুদ্ধ করা? কৌরব টিমে ওর যা ইম্পর্ট্যান্স ছিল, চাইলেই তখুনি অন্য কেউ সানন্দে নিজের রথ দিয়ে দিত। তা নয়কো, একটা খারাপ, বসে যাওয়া রথের চাকা তুলতে জীবনটা খোয়াল। আরে অর্জুনের, মানে এসট্যাবলিশমেন্ট-এর সঙ্গে মরণপণ লড়াই, তখন তুই রথের চাকা নিয়ে ভাববি? তুই অ্যান্টি-হিরো, কোনও লড়াই ছাড়া রথের চাকা বসে গেল আর হেরে গেলি? তা হলে সম্মানটা কোথায় থাকল?

এইখানেই সাহেবদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। ওরা সব জিনিস, সব প্ল্যান মজবুত করে বানায়। সাধে কী আর দুশো বছর আমাদেরই বুকে বসে, আমাদেরই দাড়ি ওপড়াল আর রানির আলমারি বোঝাই হল সম্পদে! বেন হার সিনেমার রথখানা মনে আছে? রথ হো তো অ্যায়সা। কী সলিড। নিশ্চয়ই সূর্যের সপ্তাশ্বরথের ব্লু-প্রিন্ট টুকে বানানো। ওরা খাটে কিন্তু! যে কোনও জিনিসকে পারফেক্ট করে তোলে। চার্লটন হেস্টন-এর চ্যারিয়টের চাকা দেখেছিলে? ওই হচ্ছে যুদ্ধের রথ। কম করে ১৩৩ রকম লিভার, ৪৪ রকম পুলি, ৫৭৭টা নাট-বল্টু না থাকলে একটা শক্তপোক্ত যান মনে হয়? কনফিডেন্স পাওয়া যায়? টানা-রিকশার মতো যখন-তখন উল্টে পড়বে তো! প্রতি সেকেন্ডে টেনশন। আমার ধারণা গিয়ারও ছিল নিশ্চয়। হ্যাঁ, তো সেই রথকে নষ্ট করার জন্য অনেক ফিকির বার করতে হয়েছিল বাপু। অভিশাপও নয়, অদৃষ্টও নয়। অন্য রথের চাকার সঙ্গে ফিট করে দেওয়া হয়েছিল গ্রিলিং মেশিন টাইপের কিছু একটা। আমাদের রথগুলো তো সব সে তুলনায় নস্যি!

তবে হ্যাঁ, রথের বাজারে নতুন একখানা জিনিস দিয়েছিলেন বটে লালকৃষ্ণ আডবাণী। গুজরাতের সোমনাথ থেকে উত্তরপ্রদেশের রামজন্মভূমিতে যে আদ্যিকালের রথে চেপে যাওয়া যাবে না, তা নিশ্চিত করে বুঝে ফেলেছিলেন তিনি। গেলেও যে ভোট পাওয়া যাবে না, এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত ছিলেন। অতএব ম্যাটাডর-এর চাকা অটুট রেখে, ওপরে চাপিয়ে দিলেন রথের মহিমা। তাঁর পার্সোনাল রথযাত্রার কাহিনিটা খানিক কর্ণের মতোই হয়ে গেল বটে, প্রবল পরাক্রম থাকা সত্ত্বেও সূতপুত্র টাইপ ব্রাত্য থেকে গেলেন টিমে, কিন্তু মানতেই হবে, সেই রাম-রথের দৌলতেই তো ১৯৯১-এ দিল্লির দরবারে বিজেপি’র আসন-সংখ্যা লাফিয়ে ১২৫।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sanchari Mukhopadhyay rath mahabharata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE