সেফুল্লো সাইপভ-এর নৃশংস সন্ত্রাসের রকম দেখিয়া আরও এক বার স্তব্ধ হইতে হয়। এই ভয়ংকর বিধ্বংসী ক্রোধের উৎস কোথায়, ইহার নিরাময় কী, ভাবিয়া কূলকিনারা পাওয়া যায় না। দুনিয়াময় সাধারণ মানুষকে যে নির্মেঘ আকাশ হইতে বজ্রনিপাতের মতো আরও কত ভয়ের মোকাবিলা করিতে হইবে, কে জানে। এগারোটি প্রাণ বেঘোরে বিনষ্ট হইল, আরও অনেকে এখনও আহত, যন্ত্রণাকাতর। পূর্বে কোনও অপরাধ-ইতিহাস নাই, এমন একটিমাত্র মানুষ যখন এই অমানবিক কাণ্ড ঘটায়, কোনও বড় সংগঠনের প্রশ্রয় ছাড়াই একক দায়িত্বে এত বড় জঙ্গি হানা হানিয়া ফেলে, তখন গোটা সমাজের উপর এক ভয়ানক চাপ তৈরি হয়। এক দিকে উদ্ভূত হয় এক ভিত্তিহীন কিন্তু প্রবলাকার ভয়: যেহেতু ব্যক্তিটি পরিচয়ে মুসলিম, সুতরাং মুহূর্তেমধ্যে দেশের মুসলিম নাগরিক কিংবা অভিবাসী কিংবা অবৈধ বাসিন্দা, সকলেই নূতন করিয়া আতঙ্কিত হন, তাঁহাদের উপর নূতন করিয়া কখন কোন রাষ্ট্রীয় প্রত্যাঘাতের চাপ নামিয়া আসিবে এই দুশ্চিন্তায় গ্রস্ত হন। অন্য দিকে, সমাজ-প্রশাসনের দায়িত্বে যাঁহারা আছেন, ‘লোন উল্ফ’ (একক ঘাতক) কী ভাবে সামলাইতে হয় না জানিয়া তাঁহারা (যেমন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প) সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত প্রত্যাঘাতের পরিকল্পনা আঁটিতে শুরু করেন। সমাজ যেন মুহূর্তে দ্বিধাবিভক্ত হইয়া যায়। আর সন্ত্রাসের কারবারিরা যেহেতু এই মুখোমুখি যুদ্ধটাই চালু করিতে চাহিতেছেন, তাঁহারা সাফল্যের হাসি হাসেন। সেফুল্লোরা এই ভাবেই জয়ী: প্যারিস, ব্রাসেলস, লন্ডন, নিউ ইয়র্কে বার বার একক প্রয়াসের দ্বারা সন্ত্রাসের বড় কারবারিদের তাঁহারা জিতাইয়া দেন। সন্ত্রাসযুদ্ধ অর্থাৎ ত্রাস তৈরির যুদ্ধটিকে বিপুল ভাবে সফল করিয়া দেন।
এই জন্যই সেফুল্লোরা আরও বিপজ্জনক। যতক্ষণ সন্ত্রাস কোনও সংগঠন বা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংঘটিত হয়, তাহার চ্যালেঞ্জটি এক রকম। কী ভাবে ট্রেন বা প্লেন-এ আঘাত হানিয়া মানুষ মারিতে হয়, তাহাও এক রকমের প্রশিক্ষণ, তাহার প্রতিরোধেরও এক প্রকরণ থাকে। কিন্তু লন্ডন ব্রিজের গাড়িচালক কিংবা ম্যানহাটনের ট্রাকচালক যখন প্রমাণ করিয়া দেন, যে কোনও গাড়ি বা ট্রাক মুহূর্তে বিধ্বংসী অস্ত্র হইয়া উঠিতে পারে, ইহার প্রতিরোধ তৈরি প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে চলিয়া যায়। কোনও প্রশাসন কিংবা কোনও গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে এই সংকট হইতে বাহির হইবার পথ বাতলানো দুরূহ। নতুবা প্রতিটি মানুষকেই নজরদারির মধ্যে রাখিতে হয়, যাহা প্রায়োগিক ভাবে অসম্ভব, এবং আদর্শগত ভাবে অনৈতিক। বিশেষত গণতান্ত্রিক উদার সমাজের কাছে এই দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি সামলানোর পথ অজানা।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য ভাবেন, তিনি সবই জানেন, এবং অতি প্রাঞ্জল ভাবে জানেন। তাই চব্বিশ ঘণ্টা না পুরাইতেই তাঁহার দাওয়াই, সেফুল্লো যেহেতু উজবেকিস্তান হইতে ‘ডাইভারসিটি ভিসা লটারি প্রোগ্রাম’-এর মাধ্যমে মার্কিন দেশের বাসিন্দা হইয়াছিলেন, তাহা বাতিল হইল। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে যে সব দেশ হইতে কম সংখ্যায় অভিবাসী আসেন, সেখান হইতে লটারির মাধ্যমে অভিবাসনের সুযোগ করিয়া দেওয়া হয়। ট্রাম্পের মতো সকলেই সরলীকরণে বিশ্বাসী নহেন, তাই একটি ভিসা প্রোগ্রাম বাতিল করিলেই বিপদ উধাও হইবে এমন সকলে ভাবিতে পারেন না। সেই অবিশ্বাসীরা স্বভাবতই প্রতিবাদে উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছেন। মুশকিল হইল, রক্ষণশীলপ্রবরের বিরুদ্ধে লিবারালদের এই প্রতিবাদের মধ্যেও একটি সরলীকরণ আছে। সংকট সত্যই গভীর। উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাহার কোন অস্ত্র দিয়া কী ভাবে আত্মরক্ষা করিতে পারে, তাহা চটজলদি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিষয় নহে। ঠান্ডা মাথায় পর্যালোচনার প্রয়োজন, বিরুদ্ধ মতের আদানপ্রদানও প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy