Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

সত্যের বিড়ম্বনা

বাহিরের বিচারে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দুই বৃহত্তম গণতন্ত্র। অন্তরের সত্য এই যে, গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত নেতারাও মনে করেন, ক্ষমতাসীন নেতা যাহা বলেন তাহাই তথ্য, তাঁহার বয়ানের সীমা সত্যেরও সীমা।

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৮ ১৭:৩৬
Share: Save:

ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা— পুরানো কথা। নূতন কথা: শাসক সত্য সংবাদমাধ্যম মিথ্যা। সংবাদমাধ্যম শাসকের সমালোচনা করিলে তাহার বিরুদ্ধে মিথ্যাভাষণের অভিযোগ নূতন নহে। সংবাদমাধ্যম অপ্রিয় সত্য বলিলে শাসকের রাগ হয়, মিথ্যাভাষণের অভিযোগে সেই রাগের প্রকাশ ঘটে। তাঁহারা সংবাদমাধ্যমের সত্যের উপরে আপনার রচিত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করিতে ব্যগ্র হইয়া উঠেন। যুগে যুগে এমনই ঘটিয়াছে। এ রাজ্যে পূর্বে সিপিআইএম দলটিও তাহাদের মুখপত্রে তাহাদের নির্মিত সত্য প্রচার করিয়াছে। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরের সম্মুখীন হইতেই রাজি নহেন, তিনি তাঁহার মনের কথা সরাসরি জনগণকে বলিতে বিশ্বাসী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলিকে মিথ্যা সংবাদ প্রচারে নিয়মিত অভিযুক্ত করিয়া থাকেন। সেই ট্র্যাডিশন সর্বত্র চলিতেছে। এই বঙ্গেও।

বাহিরের বিচারে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দুই বৃহত্তম গণতন্ত্র। অন্তরের সত্য এই যে, গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত নেতারাও মনে করেন, ক্ষমতাসীন নেতা যাহা বলেন তাহাই তথ্য, তাঁহার বয়ানের সীমা সত্যেরও সীমা। আধিকারিকের ফাইলে তাহার বিবরণই ‘ঘটনা,’ গণমাধ্যমে প্রচারিত হইলে তাহাই ‘সংবাদ’। সাংবাদিক পেশার কারণে চক্ষু-কর্ণ কাজে লাগাইয়া কী ঘটিতেছে তাহা প্রত্যক্ষ করিতে যান। এমনকী ক্যামেরায় তাহার ছবি ধরিয়াও রাখিতে যান। তাই সরকারি বয়ানের সহিত তাঁহার বিরোধ বাধে। অতএব নেতা-নেত্রীদের চক্ষে সাংবাদিক যে ‘বিরোধী’ বলিয়া ঠাহর হইবে, তাহাতে আশ্চর্য কী। বিরোধীদের সহিত নেতারা যে রূপ আচরণ করিয়া থাকেন, সাংবাদিকের ভাগ্যেও নানা ক্ষেত্রে তাহাই জুটিয়া থাকে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নের শেষ দিনে গোটা রাজ্যে বেশ কয়েক জন সাংবাদিক প্রহৃত হইয়াছেন, দুই জনের মাথা ফাটিয়াছে। আক্রান্ত সাংবাদিকদের মধ্যে দুই জন মহিলা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বে সাংবাদিক নিগ্রহের নূতন দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছে পশ্চিমবঙ্গ। সাংবাদিক হেনস্থার নূতন কৌশলও দেখা দিয়াছে, কর্মরত সাংবাদিকদের কার্যত অপহরণ করিয়া বন্দি করিয়া রাখা। অভিযোগ প্রধানত শাসকদের বিরুদ্ধেই, কিন্তু বিরোধীরাও নিষ্কলঙ্ক নহেন। মারধর, গালিগালাজ, ক্যামেরা ছিনতাই সম্ভবত আর অপরাধ বলিয়া গণ্য হয় না, কারণ পুলিশ তাহা ঘটিতে দেখিয়াও নির্বিকার। রাজধর্ম বুঝি তত ক্ষণই পালনীয়, যত ক্ষণ তাহাতে শাসকের অসুবিধা নাই।

সাংবাদিকের সুরক্ষা গণতন্ত্রের একটি পরিমাপ। তাহা উন্নয়নেরও সূচক, কারণ বাক্‌স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রহিয়াছে মানব উন্নয়নের কেন্দ্রে। তাহার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিবার দায় সাংবাদিকের। ক্ষমতাসীনের স্বার্থ-নির্মিত, বাস্তব-বর্জিত বয়ানের বিরোধিতা করিবার কাজটিই সাংবাদিকের কাজ। সাংবাদিকের বর্ম-শিরস্ত্রাণ কিছুই নাই, তাঁহার একটিই অস্ত্র, তাঁহার প্রশ্ন। সাংবাদিক যত দিন প্রশ্ন করিতে পারিবেন, তাহার উত্তর দিবার দায় হইতে রাষ্ট্র নিজেকে মুক্ত করিতে পারিবে না। রাষ্ট্রক্ষমতাকে এই রূপে দায়বদ্ধ করিয়া রাখিবার কাজটি সাংবাদিককে করিতেই হইবে। তাঁহার একমাত্র লক্ষ্য সত্যের অন্বেষণ। সেই সত্য প্রিয় হউক বা অপ্রিয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Journalists security
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE