Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
মোদীর রাজনীতিই জাগিয়ে তুলল ‘দ্রাবিড়নাড়ু’র দাবি

দক্ষিণী জাতীয়তার উত্থান?

এই অন্যান্য ঘটনার মধ্যে প্রথমেই আসে ‘দ্রাবিড়নাড়ু’র দাবিটির কথা। তামিলনাড়ুর ডিএমকে দলনেতা স্ট্যালিন সময় বুঝে দ্রাবিড়নাড়ুর কথা বললেন।

অভিনব: অন্ধ্রপ্রদেশের বিশেষ মর্যাদার দাবিতে তেলুগু দেশম পার্টির সাংসদ ডি আর শিবপ্রসাদ। দিল্লি, মার্চ ২০১৮। ছবি: পিটিআই

অভিনব: অন্ধ্রপ্রদেশের বিশেষ মর্যাদার দাবিতে তেলুগু দেশম পার্টির সাংসদ ডি আর শিবপ্রসাদ। দিল্লি, মার্চ ২০১৮। ছবি: পিটিআই

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

আমাদের সংসদে ঠিক যে সময়ে তোলপাড় চলছিল, অন্ধ্রপ্রদেশ কেন স্পেশ্যাল স্টেটাস বা বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা পাবে না, তাই নিয়ে চন্দ্রবাবু নায়ডুরা হট্টগোল পাকাচ্ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিরুদ্ধে একটার পর একটা অনাস্থা প্রস্তাব আসছিল, তেলুগু দেশম পার্টির রঙ্গপ্রিয় সাংসদ শিবপ্রসাদ মশাই কখনও বাঁশি হাতে ভগবান কৃষ্ণ সেজে সংসদের অলিন্দে ঘুরছিলেন, কখনও তেলুগু মেয়ের সাজে হলুদ শাড়ি লাল ফুল মাথায় সবাইকে চমকে দিচ্ছিলেন— সেই সময়ই দিল্লি থেকে বহু দূরে দাক্ষিণাত্যের নানা কোণে ঘটে যাচ্ছিল আরও কিছু ঘটনা। এই বাংলা থেকে সেসব দিকে একটু কমই মন দেওয়া হয়েছে। অথচ ঘটনা হল, চন্দ্রবাবু নায়ডুরা যে বক্তব্য নিয়ে সংসদ অচল করছিলেন, দক্ষিণ ভারতের সেই অন্যান্য ঘটনার মধ্যেও কিন্তু সেই একই বক্তব্য। একই রাজনীতির ছাপ তাদের মধ্যে। একই ধ্বনির প্রতিধ্বনি।

এই অন্যান্য ঘটনার মধ্যে প্রথমেই আসে ‘দ্রাবিড়নাড়ু’র দাবিটির কথা। তামিলনাড়ুর ডিএমকে দলনেতা স্ট্যালিন সময় বুঝে দ্রাবিড়নাড়ুর কথা বললেন। বললেন, তাঁর রাজ্যের বাইরে অন্য দক্ষিণী রাজ্যগুলি আগ্রহী থাকলে দ্রাবিড়নাড়ুর দাবি নিয়ে ডিএমকে অনেক দূর লড়ে যেতে রাজি।

চার পাশের মেজাজমর্জি দেখেই ধুয়োটা তুলেছিলেন স্ট্যালিন। দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে মার্চ মাস জুড়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। তামিলনাড়ুর বিরোধী নেতা স্ট্যালিন দ্রাবিড়নাড়ুর পক্ষে যে যুক্তি দিলেন, অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবুও বিধানসভায় সেই একই অভিযোগ তুললেন। দক্ষিণের রাজ্যগুলি দিল্লিকে বেশি কর দিচ্ছে, সেই করের অর্থ দিয়ে উত্তর ভারতের প্রদেশগুলির বর্ধিত খরচপাতি মেটানো হচ্ছে। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের আর্থিক বিলিব্যবস্থাই স্পষ্ট বলে দেয়, কীভাবে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের সময় আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে অন্ধ্রের মতো সমৃদ্ধ রাজ্যগুলি। সংসদকক্ষে এ নিয়ে যত চেঁচামেচি শোনা গিয়েছে তার ডেসিবেল অনেক বেশি হতে পারে, কিন্তু সত্যি বলতে কী, চন্দ্রবাবুর বিধানসভার বক্তৃতার ভাষা আরও পরিষ্কার, আরও চাঁচাছোলা।

না হয়ে উপায় কী। বিরোধীদের প্রবল চাপের মধ্যে আছেন অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের অন্যতম বিরোধী দল জনসেনা পার্টির পুরোধা, এক কালের জনপ্রিয় অভিনেতা, পবন কল্যাণ, কিছু দিন ধরেই তাঁর তথা বিজেপি-টিডিপি জোটের বিস্তর সমালোচনা করছেন, রাজ্যের স্বার্থ রক্ষার জন্য যথেষ্ট সরব হচ্ছেন না চন্দ্রবাবুর মতো স্বার্থলোভী সুযোগসন্ধানীরা, এই হল অভিযোগ। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনে রাজ্যে বিরাট স্বার্থহানির পরও কী করে কেন্দ্রে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন? ইত্যাদি। অর্থাৎ তেলুগু দেশম পার্টির বিধানসভার পারফরম্যান্সটাকে বুঝতে গেলে তাদের রাজ্যের ভেতরকার চাপটাকে না বুঝলে চলবে না। রাজ্যের চৌহদ্দিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতেই টিডিপি মুখ্যমন্ত্রীকে কেন্দ্রে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হল!

পরিস্থিতি কর্নাটকেও অগ্নিগর্ভ। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়াও অক্ষরে-অক্ষরে একই অভিযোগ তুলেছেন এর মধ্যে। কংগ্রেসের ‘একা-কুম্ভ’ মুখ্যমন্ত্রীটির সামনে এখন বিধানসভা নির্বাচনের তোলপাড়। কর্নাটক চিরকালই উলটো পথের পথিক, গোটা দেশের হাওয়া যখন এক দিকে বয়, কর্নাটক তখনও হাওয়া সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে বওয়ানোর শক্তি রাখে। বাকি দেশে কী হচ্ছে, তাতে তাদের ভারী বয়েই যায়, তারা কেবল নিজেদের রাজ্যের বাস্তবটা দেখেশুনেই ভোট দেয়। (সেই জন্যই ১৯৭৭ সালে গোটা দেশে কংগ্রেস উৎখাত হয়ে যাওয়ার সময়েও শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধী এই রাজ্য থেকেই ভোটে দাঁড়ানোটা নিরাপদ মনে করেছিলেন!) আর আজ, সেই কারণেই সিদ্দারামাইয়া খোলা গলায় পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের প্রস্তাবগুলির সবচেয়ে বেশি চুলচেরা বিচার করতে পারলেন। তাঁর সাফ কথা, দক্ষিণের রাজ্যগুলোর সম্পদের ভিত্তিতেই তৈরি হচ্ছে উত্তর ভারতের যাবতীয় সুযোগসুবিধা। তিনি অঙ্কের হিসাব দিয়ে দেখিয়েছেন, উত্তরের জনসংখ্যার বৃদ্ধির জন্য কীভাবে পরোক্ষ চেষ্টা হচ্ছে দক্ষিণের আর্থিক পুঁজির ভিত্তিতে। এই যেমন, ২০১১ জনগণনা অনুসারে তৈরি ২০১৮-১৯ সালের বাজেেট দেখা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের অর্থনীতি তামিলনাড়ুর অর্থনীতির চেয়ে ৭ শতাংশ ছোট হওয়া সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশের বাজেট বরাদ্দ কিন্তু তামিলনাডুর থেকে ৩৬ শতাংশ বেশি। একই ছবি কেরল কর্নাটক গুজরাত মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। দক্ষিণের প্রতিটি রাজ্যেরই নিজস্ব অর্থনীতির যা শক্তি, তার তুলনায় অল্প বাজেট তাদের জন্য বরাদ্দ। আর এই বাজেট হিসাবের মধ্যে যেহেতু কেন্দ্রীয় বরাদ্দের পাশাপাশি রাজ্যগুলির নিজেদের রাজস্বের ভাগও থাকে, দক্ষিণী রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এই ‘নিজেদের টাকার’ পরিমাণটা অনুপাতে অনেক বেশি। কন্নড় মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, শতকরা হিসাবে কর্নাটক রাজ্যের অবদানটাই দেশের মধ্যে সর্বাধিক।

মূল কথাটা সহজ। কেন্দ্রের নীতির ফলে সম্পন্ন রাজ্যগুলোর স্বার্থের বড় রকমের ক্ষতি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা দেখানোর বাড়াবাড়িতে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রের রাজনীতির সঙ্গে অর্থ কমিশনের এই সব বন্দোবস্তের একটা গভীর নিহিত যোগ আছে, থাকতেই পারে— কিন্তু সত্যি বলতে কী, রাজ্যের রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষতি করে কেন্দ্রের রাজনীতির মঙ্গল করার দায়টা ফেডারাল গণতন্ত্রে থাকতে পারে না। একটা বিহিত চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা শুনলাম স্ট্যালিনের দ্রাবিড়নাড়ু আহ্বান। সময়টা ভাল বেছেছেন তিনি। দক্ষিণের রাজ্যগুলি ক্ষোভে ফুঁসছে, রাজ্যভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সকলের একই ক্ষোভ। সুতরাং এই তো সময়, বিজেপির ‘মহাভারতীয়’ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে একটা দক্ষিণী উপ-জাতীয়তাবাদ (সাব-ন্যাশনালিজম)-এর ধুয়ো তোলার জন্য। তাতে রাজ্যের অর্থনৈতিক লাভ হোক না হোক, বিজেপি-বিরোধিতার রাজনৈতিক নৌকোটা আর একটু তরতর করে বাওয়া যাবে।

এই দ্রাবিড়নাড়ু ব্যাপারটা অবশ্য মোটেই নতুন নয়। সেই ১৯৬৩ সালে ডিএমকে শব্দটার জন্ম দিয়েছিল। তার পর থেকে এক-এক সময়ে এক-এক অর্থে দ্রাবিড়নাড়ুর কথা শোনা গিয়েছে, আবার তা কোথায় যেন হারিয়েও গিয়েছে। কখনও তার দাবি, রাজ্যের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা চাই। কখনও আবার, প্রাদেশিক স্বশাসন চাই। অর্থাৎ শব্দটা একটা বেশ নমনীয় নলের মতো, স্ট্যালিন এবার তাতে কিছু সময়োচিত অভিযোগ ভরে দিয়ে রাজনীতি মঞ্চে তাকে ছুঁচোবাজির মতো ছেড়ে দিয়েছেন। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ কেবল অর্থনীতি-বিষয়ক নয়, সংস্কৃতি ও ভাষাবিষয়কও বটে। দক্ষিণের উপর হিন্দি ও গোবলয়-সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার বাড়াবাড়ির কথা আলাদা করে বলেছেন তিনি। বাস্তবিক, কর্নাটক আর তামিলনাড়ুতে হিন্দির বিরুদ্ধে আবেগ এখন বেশ তুঙ্গে। কর্নাটকের স্টেশনগুলিতে তিন ভাষায় লেখা জায়গার নামের মধ্যে কন্নড় আর ইংরেজিকে রেখে কে বা কারা যেন হিন্দি শব্দগুলোর উপর নিয়মিত কালো কালির পোঁচ মেরে দিচ্ছে। বড় শহরগুলোতেও দেখা যাচ্ছে ‘হিন্দি চাই না’ প্ল্যাকার্ড সাইনবোর্ড। এ কি উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দক্ষিণের রুখে ওঠা? না কি বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের স্কোর বাড়ানোর চেষ্টা? না কি দুটোই মিলেমিশে? একটা জাতীয়তাবাদের ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে আর একটা জাতীয়তার মঞ্চ তৈরির চেষ্টা?

কেন্দ্রের স্বার্থের সঙ্গে রাজ্যের স্বার্থের বিরোধিতা ব্যাপারটা এদেশে নতুন নয়। কিন্তু লক্ষণীয়— মাননীয় মোদীর রাজনীতি কীভাবে সেই ঘুমন্ত দানবকে জাগিয়ে দিল। এতগুলো রাজ্যে আবার নতুন করে সুরটা বাঁধা হল। ব্যাপারটা আকস্মিক নয়, অপ্রত্যাশিত তো নয়ই। ‘এক’ সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতির আদর্শটিকে দেশের সর্বত্র চাপিয়ে দেওয়ার অবধারিত ফল— ‘অনেক’-এর ক্ষোভ-ক্রোধ। ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া সব সময় সমান মাপের হয়, কে যেন বলেছিলেন। শুধু ধর্ম ও জাতের প্রতিক্রিয়াই তো নয়, আরও অনেক ঘুমিয়ে-থাকা প্রতিক্রিয়া আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে তাই।

মুশকিল বটে! মোদী-ব্র্যান্ডের ছাপ-মারা ঐক্যের জন্য দেখছি মোটে প্রস্তুত নয় এই দুষ্টু দেশটা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE