Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ওলো ডিজিটাল সই

মালয়ালি একটি পত্রিকার প্রচ্ছদে স্তন্যদায়িনীর ছবি নিয়ে হইচই চলছিল ক’দিন ধরে। সোশ্যাল মিডিয়া মনে করিয়ে দিল, ঠিক একই রকম ডাকটিকিট এসেছিল আশির দশকে!

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৩০
Share: Save:

বডোদরার মেয়ে কৃপা জোশী। আঁকিয়ে। এখন ব্রিটেনে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই মোটাসোটা গোলগাল চেহারা। বন্ধুরা মোটি বলে খেপাত। কৃপা ‘মিস মোটি’ বলে একটা কমিক্স চরিত্র তৈরি করলেন। রেখা আর লেখায় মিলে ‘মিস মোটি’ ওয়েবসাইটে আত্মপ্রকাশ করল। জনপ্রিয়তা বাড়ার পরে এল বই, পোস্টার। কী রকম? ‘মোটি’ সাঁতার কাটতে চায়! সকলে তাকে ‘হিপো’ বলে খেপায়! কিন্তু ‘হিপো’ নিজে তো দিব্যি সাঁতার কাটে! কৃপার ছবিতে অতএব সাঁতার পোশাক পরা ‘মিস মোটি’ জলে নামে! আর ছবির চার পাশে মিনিয়েচার ঘরানার ঢংয়ে দেখা যায় অজস্র জলহস্তী! কোনও সংগঠন নয়, প্রতিষ্ঠান নয়। শরীরের মাপজোক নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এ কৃপার একান্ত লড়াই।

মালয়ালি একটি পত্রিকার প্রচ্ছদে স্তন্যদায়িনীর ছবি নিয়ে হইচই চলছিল ক’দিন ধরে। সোশ্যাল মিডিয়া মনে করিয়ে দিল, ঠিক একই রকম ডাকটিকিট এসেছিল আশির দশকে! তখন তো এত কথা ওঠেনি! এই দ্বিচারিতা ফাঁস করে দিল ‘লেডিজ ফিঙ্গার’ ওয়েবসাইটে। সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি, সব কিছুকে মেয়েদের দৃষ্টিতে দেখে তারা। সে দৃষ্টি যেমন ধারালো, তেমনই রসালো।

‘ফেমিনিজম ইন ইন্ডিয়া’ আবার শুধু ওয়েবসাইটেই আটকে নেই। চাইলে হোয়াটসঅ্যাপে তারা নিয়মিত তাদের নতুন লেখা পাঠিয়ে দেয়। ইংরেজির সঙ্গে হিন্দি লেখাও ছাপা হয়। ওয়েবসাইটে একটা আলাদা কলাম আছে ইতিহাস আর নারীকে নিয়ে। জানুয়ারি মাসে উনিশ শতকের বাঙালি কবি তরু দত্ত সম্পর্কে একটা লেখা ছিল। ‘বম্বে’ ছবির গোড়ার যুগের এক সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন সরস্বতী দেবী। তাঁকেও খুঁজে পাওয়া গেল। একটি ‘ট্রেন্ডিং’ নিবন্ধ— পুরুষ আর মেয়েদের অরগ্যাজম
কি আলাদা?

টুকরো টুকরো এই তিনটে উদাহরণ একটা দিকনির্দেশ দেয়। ডিজিটাল দুনিয়ায় নারীবাদের ক্রমবিস্তার, যাকে ডিজিটাল নারীবাদও বলা হচ্ছে আজকাল। প্রাতিষ্ঠানিক নারীবাদের পাশাপাশিই এ আর এক উন্মুক্ত পরিসর, যেখানে নানা জনে নানা কথা বলছেন, লিখছেন, ভাবছেন, তর্ক করছেন। গত কয়েক বছরে ডিজিটাল বিপ্লবের সুযোগে অগুন্তি মানুষ কোনও প্রতিষ্ঠান, কোনও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কেউ ছবি তুলে, কেউ কবিতা লিখে, কেউ গান গেয়ে, কেউ বা ছোট ছবি বানিয়ে সরাসরি তা দুনিয়ার দরবারে পেশ করেছেন। কোনও লেবেলের প্রয়োজন হয়নি, কারও মুখাপেক্ষী হতে হয়নি, পদে পদে প্রথাগত প্রশিক্ষণের প্রমাণ দাখিল করতে হয়নি। ডিজিটাল গণতন্ত্রের এই মঞ্চটাই কাজে লাগিয়েছেন মেয়েরাও। কখনও একা, কখনও জনাকয়েকে মিলে একটা ব্লগ অন্তত শুরু করে দিয়েছেন। ভাগ করে নিয়েছেন নিজের জীবনের গল্প, মেয়েদের জীবন নিয়ে নিজের ভাবনার কথা। যেমন ধরা যাক, ‘ইন্ডিয়ান হোম মেকার’ নামে ব্লগটি। যার ট্যাগলাইনে বলা আছে, ‘মাই লাইফ অ্যান্ড এভরিথিং দ্যাট টাচেস ইট...’। আমি যে-ই হই না কেন, আমার কথা আমি দু’ছত্র লিখে ফেলতেই পারি— আত্মউন্মোচনের এই সুযোগ পাওয়া ডিজিটাল মাধ্যমে অনেক সহজ। যাদের জন্য আজ নারীবাদ নিয়ে আলাপ-আলোচনার পরিসর আগের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত, নারীবাদ নিয়ে আগ্রহের জনভিত্তি অনেক বেশি ব্যাপ্ত। ২০১০ সাল থেকে শুরু করে একা ‘উইমেন্স ওয়েব’-এরই পাঠকসংখ্যা এখন ৬০ লক্ষ। আবার ‘#মিটু’ আন্দোলনে তো কত মেয়ে কত অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন ফেসবুকে, কখনও নাম দিয়ে, কখনও না দিয়ে! ডিজিটাল মঞ্চ হয়ে উঠল বিশ্বায়িত প্রতিবাদের মঞ্চ। সঙ্গে আছে মাল্টিমিডিয়ার সুবিধা, অর্থাৎ একাধারে লেখা-ছবি-ভিডিয়ো-অডিয়ো ক্লিপ সবই সেখানে কাজে লাগানো যায়। জায়গা করে দেওয়া যায় একাধিক ভাষাকেও। আদিবাসী, বহুজন ও দলিত মেয়েদের ওয়েবসাইট ‘শবরী’তে একই সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি এবং দক্ষিণী ভাষায় লেখা দেওয়া আছে। তামিল ভাষায় গত আট বছর ধরে ‘থুমাই’ নামে একটা ওয়েবসাইট চলছে। তামিলে থুমাই মানে রজোরক্ত!

এ রাজ্যে ‘এখন আলাপ’-এর ব্লগ নিয়মিত বাংলায় লেখা প্রকাশ করে। অনিতা অগ্নিহোত্রীর ধারাবাহিক কলাম ‘ভূমিকন্যাদের কথা’ পড়ার সুযোগ মিলছে সেখানে। আর একটা নতুন ধরনের আদানপ্রদানও দেখা যাচ্ছে মুদ্রিত পত্রিকার সঙ্গে ডিজিটাল মাধ্যমের। যেমন মুর্শিদাবাদ থেকে সম্প্রতি মেয়েদের একটি পত্রিকা বেরোল, তার নাম কিন্তু ‘ফেমিনিজম ডট কম’! সেখানে জেলার নানা পেশার মেয়েরা— কেউ চাষের কাজ করেন, কেউ বিড়ি বাঁধেন, কেউ সেলাই করেন— নিজেদের কথা বললেন নিজের বয়ানে। আবার ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’ পত্রিকায় প্রকাশিত শঙ্করী মণ্ডলের লেখা ‘এখন আলাপ’-এর ব্লগে উঠে এল। ডিজিটাল মাধ্যমের সবচেয়ে বড় দিকই হল এই ভূগোলের বেড়া ডিঙিয়ে যাওয়ার সুযোগ। ফেসবুকে যেমন একটি গ্রুপ রয়েছে, ‘রাইট টু পি’। কেন রাস্তায়-ঘাটে, ট্রেনে-বাসে মেয়েদের শৌচাগার থাকবে না যথেষ্ট, সে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেখানে। ডিজিটাল দুনিয়ার প্রভাব বাড়ছে। নারীবাদেরও দায় আছে নিজেকে ‘আপডেট’ করে চলার। ডিজিটাল নারীবাদ তারই ফসল, সময়োপযোগী ফসল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

feminism digital world
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE