Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

একটি অন্য রকম ছাপাখানা

শতবর্ষে পড়ল রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন প্রেস। এই শতবর্ষ শুধু রবীন্দ্রনাথের বইয়ের প্রধান মুদ্রক একটি ছাপাখানার নয়। সেটুকুই শান্তিনিকেতন প্রেসের পরিচয় নয়। আসলে তা রবীন্দ্রনাথের ‘সমস্ত জাতিগত ভূগোলবৃত্তান্তের অতীত’ বিশিষ্ট জাতীয়তাবোধেরও প্রকাশ।

আশিস পাঠক
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

শতবর্ষে পড়ল রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন প্রেস। এই শতবর্ষ শুধু রবীন্দ্রনাথের বইয়ের প্রধান মুদ্রক একটি ছাপাখানার নয়। সেটুকুই শান্তিনিকেতন প্রেসের পরিচয় নয়। আসলে তা রবীন্দ্রনাথের ‘সমস্ত জাতিগত ভূগোলবৃত্তান্তের অতীত’ বিশিষ্ট জাতীয়তাবোধেরও প্রকাশ।

আপাত ভাবে কাকতালীয় হলেও, রবীন্দ্রনাথের ওই বিশিষ্ট জাতীয়তাবোধের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল শান্তিনিকেতন প্রেসের আদি ইতিহাস। ৮ জানুয়ারি ১৯১৭ আমেরিকার নেব্রাস্কা স্টেটের লিঙ্কন শহরে অলিভার থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ন্যাশনালিজ়ম’। আর ওই দিনই লিঙ্কনের বাসিন্দারা রবীন্দ্রনাথকে একটি অভিনব উপহার দেন৷ একটি মুদ্রণযন্ত্র৷ নাম ‘দ্য লিঙ্কন প্রেস’। উপহারটি ছিল শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের জন্য। যন্ত্রটির গায়ে ধাতুর পাতে খোদাই করা ছিল: প্রেজ়েন্টেড টু দ্য বয়েজ় অব শান্তিনিকেতন।

রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে ওই ছেলেদের স্কুলের অর্থসংগ্রহের জন্যই আমেরিকায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর মাথার উপর ত্রিশ হাজার টাকার দেনা, যার জন্য মাসে মাসে সুদ দিতে হয়। তার উপর পরিকল্পনা আছে হাসপাতাল আর একটি টেকনিক্যাল বিভাগ খোলার। শান্তিনিকেতনের খড়ের চালের বাড়িগুলোকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে পাকা করতে হবে। সে সবের জন্যই রীতিমতো ডলারের বিনিময়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো, যার বেশ কয়েকটির বিষয় জাতীয়তাবাদ।

মুদ্রণযন্ত্রের সঙ্গে এক ধরনের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক ছাপাখানার সেই আদিপর্বেই ঘটে গিয়েছিল। সংস্কৃত যন্ত্র, নূতন বাঙ্গালা যন্ত্র বা চন্দ্রিকা যন্ত্রের মতো মুদ্রণযন্ত্র আর ছাপাখানার নাম তখন আকছার দেখা যাচ্ছে। হিন্দুমেলার প্রবর্তক নবগোপাল মিত্র ওরফে ‘ন্যাশনাল নবগোপাল’-এর অনুপ্রেরণায় যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ ‘বাঙ্গালা মুদ্রাঙ্কণের ইতিবৃত্ত ও সমালোচন’ লিখতে গিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা আসার আগে ভারতে ছাপাখানা ছিল এমনও বলতে চেয়েছেন। কিন্তু এই নামমাত্র জাতীয়তায় বিশ্বাস করতেন না রবীন্দ্রনাথ। তত দিনে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধ, ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস। ‘সমস্ত জাতিগত ভূগোলবৃত্তান্তের অতীত’ মুক্তচিন্তার আর এক রকম জাতীয়তাবোধ রূপ পেয়েছে তাঁর মধ্যে। ১১ অক্টোবর ১৯১৬ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, ‘‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে— ঐখানে সর্ব্বজাতিক মনুষ্যত্বচর্চ্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, স্বাজাতিক সঙ্কীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসচে, ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্চে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে— ঐ জায়গাটিকে সমস্ত জাতিগত ভূগোলবৃত্তান্তের অতীত করে তুলব এই আমার মনে আছে— সর্ব্বমানবের প্রথম জয়ধ্বজা ঐখানে রোপণ হবে।’’

লিঙ্কন যন্ত্র অবলম্বন করে যে ছাপাখানা শান্তিনিকেতনে তৈরি হল তার নাম হল ‘শান্তিনিকেতন প্রেস’। পরে এই ছাপাখানাতেই ‘বিশ্বগ্রন্থপ্রকাশের ব্যবস্থা’ করতে চাইবেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বগ্রন্থ, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ গ্রন্থমালা, বিদ্যার বিশ্বব্যাপী ধারার সঙ্গে বাংলা ভাষায় সাধারণ শিক্ষিত বাঙালির প্রাথমিক পরিচয় ঘটানোর লক্ষ্যে যার পরিকল্পনা। জীবিকামুখী শিক্ষার সঙ্গে, স্বনির্ভরতার সঙ্গে প্রেসটিকে জড়িয়ে নিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আদর্শ বিদ্যালয় সম্পর্কে তাঁর ধারণা, ‘‘এই বিদ্যালয়ে উৎকৃষ্ট আদর্শে চাষ করিবে, গো-পালন করিবে, কাপড় বুনিবে এবং নিজের আর্থিক সম্বল লাভের জন্য সমবায় প্রণালী অবলম্বন করিয়া ছাত্র শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হইবে।’’ হয়তো সে কারণেই শান্তিনিকেতনের এক জন সাঁওতাল ছাত্রকে কলকাতায় পাঠিয়েছেন বাঁধাইয়ের কাজ শিখতে। নিমাই, বিষ্ণুর মতো কোনও কোনও ছাত্রই শিখে নিচ্ছে হরফসজ্জার কাজ। পাশাপাশি লন্ডনের যে ‘কাউন্টি কাউন্সিল স্কুল অব এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি’তে মুদ্রণ শিখেছিলেন সুকুমার রায়, সেখানেই সুরেন্দ্রনাথ কর ভর্তি হয়েছিলেন লিথোগ্রাফি আর বই বাঁধাইয়ের কাজে। পরে তাঁর কাছেই দফতরির কাজ শিখেছিলেন কলাভবনের ছাত্র বীরভদ্র রাও আর বিশ্বভারতীর কর্মী শোকলা সাঁওতাল। সুকুমার রায়ও শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন সম্ভবত ছাপাখানাটাকে একটু খাড়া করে দেওয়ার জন্যই।

কিন্তু লিঙ্কন প্রেস উপহার পাওয়ার পরেও সে যন্ত্রে মুদ্রণে ছিল ব্রিটিশ সরকারের ‘সেন্সরের অন্যায় বাধা’। সে বাধা এতটাই যে এক সময় রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রটি লিঙ্কন শহরের অধিবাসীদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৩২৫-এর আশ্বিন, অক্টোবর ১৯১৮’য় প্রকাশিত হল শান্তিনিকেতন প্রেসে মুদ্রিত প্রথম বই, রবীন্দ্রনাথের গানের দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের করা স্বরলিপি-সহ সঙ্কলন গীত-পঞ্চাশিকা।

বইয়ের বিষয় এবং তার মুদ্রণে ক্রমেই একটা নিজস্ব চরিত্র অর্জন করতে চাইছিল শান্তিনিকেতন প্রেস, প্রথাগত ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস’-এর ধারণা থেকে যা আলাদা। ভারতবর্ষে কেন, সারা পৃথিবীতেই বোধ হয় এমন কোনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস নেই যার প্রথম মুদ্রিত বইটি গানের বই। অথবা, এমন কোনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা নেই যার প্রথম বই একটি নাটক। কিন্তু শান্তিনিকেতন প্রেসে প্রথম ছাপা বই গীত-পঞ্চাশিকা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের (তখন ‘গ্রন্থালয়’) প্রথম বই, শান্তিনিকেতন প্রেসেই মুদ্রিত, রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’৷ ১৯১৮-য় শান্তিনিকেতন প্রেস আর ১৯২৩-এ বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় প্রতিষ্ঠার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনার একটা আন্তর্জাতিক মানের ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছে। কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন বা হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস তখন প্রতিষ্ঠিত। তাদের কোনওটিকেই আদর্শ না করে সম্পূর্ণ নিজের মতো চলতে শুরু করেছিল রবীন্দ্রনাথের ছাপাখানা। শুধু মনন আর পাণ্ডিত্যের চর্চা নয়, খোলা মাঠের খেলায় সৃজনের অবসরে বেড়ে ওঠা সেই পথের বৈশিষ্ট্য।

বই তৈরির ক্ষেত্রেও একটা নিজস্ব চরিত্র আনতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এক ছাঁচে ঢালা মুদ্রিত হরফের মধ্যে এক ধরনের যান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ বার বার দেখেছিলেন। তাই ‘লাইব্রেরি’ রচনায় গ্রন্থাগারকে জেলখানার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।’’ সেই জেলখানায় একটু ব্যক্তিগত অবসর আনার জন্যই বোধ হয় বইয়ের প্রচ্ছদে হাতের লেখায় বইয়ের নাম ছাপা হয়, জার্মানির প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় ‘লেখন’ পুরোটাই হাতের লেখায় ছাপার জন্য। তারই তাগিদে হয়তো বইয়ের প্রচ্ছদে রইল অতখানি খোলা জমি, স্পেস। আর তার তুলনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এলেন প্রাচ্যেরই নিরাসক্ত সংযমের কথা, ‘‘মলাটে সাদা অক্ষরে বীথিকা যেন লেখা থাকে, আমি অলঙ্কৃত করে দেবো না।... নিজের বই সম্বন্ধে নতুন লেখকের গদগদ স্নেহের সোহাগ এতে প্রকাশ পায়। জাপানীরা তলোয়ারে কারুকার্য্য করে, খাপ রাখে অত্যন্ত সাদা...।’’

আজ, শতবর্ষে, এই একান্ত ভারতীয় অথচ ‘সমস্ত জাতিগত ভূগোলবৃত্তান্তের অতীত’ মুদ্রণ-সংস্কৃতি অন্য এক পরিপ্রেক্ষিতের সামনে দাঁড়িয়ে।

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE