Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সামান্যেই যিনি অসামান্য

শিবাদিত্য সেনের অনুবাদ যে অর্থশাস্ত্র ও দর্শনের জটিল যোগের বিষয়টাকে সাধারণ পাঠকের নাগালের মধ্যে আনতে পেরেছে, তার প্রধান কারণ, শিবাদিত্য শুধু অমর্ত্য সেনই পড়েননি, এই সংক্রান্ত আলোচনার বৃহত্তর জগৎটা ছিল তাঁর বিচরণক্ষেত্র।

অনুবাদক শিবাদিত্য সেন।

অনুবাদক শিবাদিত্য সেন।

অপ্রকাশ রায়
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:৩৩
Share: Save:

ভুলটা কী হল? আমি ভারতীয় পুরুষদেরপারফেক্ট রিপ্রেজ়েন্টেটিভ। জন্মেছিলাম ১৯৫২-র ১০ জুন, মারা গেলাম ২০১৮-র ৭ অগস্ট, ৬৬ বছর, ভারতীয় পুরুষদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু—! কথা বলার সুযোগ থাকলে ঠিক এ ভাবেই বলতেন শিবাদিত্য সেন। গড়পড়তাদের প্রতিনিধি থেকেই গড়ের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার দক্ষতা খুব বেশি লোকের থাকে না। যার থাকে, তিনিই পারেন গড়ের অনন্যতাকে উদ্‌যাপন করতে। আজন্ম শান্তিনিকেতন-নিবাসী এই মানুষটি তা পেরেছিলেন।

সাধারণের জীবন যাপন করাটা এমনিতেই কঠিন। তার ওপর যিনি পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনের পৌত্র; অণিমা ও কঙ্কর সেনের পুত্র, এবং অমর্ত্য সেনের পিসতুতো ভাই, তাঁর পক্ষে সেটা কঠিনতর। এখানেই তাঁর সাধারণত্বের বিশিষ্টতা: পরিচিতির অ-সাধারণত্ব তাঁকে ন্যুব্জ তো করতে পারেইনি, বরং বিদ্যাচর্চার অচ্ছেদ্য সংযোগ থেকে তিনি সারা জীবন গ্রহণ করে গিয়েছেন সাধারণ থাকার পাঠ। তাঁর জায়গায় থাকা লোকের পক্ষে যেটা স্বাভাবিক ছিল, তা হল প্রতিষ্ঠিত হওয়া। অথচ, সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে অর্থনীতি পড়ানো এবং অল্প কিছু অনুবাদ ও লেখালিখি ছাড়া প্রকাশ্য বিদ্যাচর্চার কোনও নিদর্শন তিনি রাখেননি। অথচ রাখতে পারতেনই। চিত্রকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, ফোটোগ্রাফি ইত্যাদি বিষয়ে গভীর আগ্রহের কথা ছেড়ে দিলেও, শুধু অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর ব্যুৎপত্তির প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর করা তর্জমাগুলো থেকে। অশোক রুদ্রের সম্পাদনায় অমর্ত্য সেনের প্রথম বাংলা প্রবন্ধ সঙ্কলন জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি(১৯৯০)-তে ‘‘শুধু তিনটি প্রবন্ধের অনুবাদই করে দেননি, সম্পাদনার কাজে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অকাতরে সময় ও শ্রম ব্যয় করে’’ সম্পাদককে ‘প্রভূত সাহায্য করেছেন।’’ অশোক রুদ্র যাঁর ওপর ভরসা করতে পারেন তাঁর দক্ষতা নিয়ে কথা চলে না। অমর্ত্য সেনের দুটি অসামান্য বই পভার্টি অ্যান্ড ফ্যামিন, এবং এথিকস অ্যান্ড ইকনমিকস-এর বাংলা অনুবাদের (যথাক্রমে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ এবং নীতি ও অর্থনীতি) সময় তা দেখা গেল। শিবাদিত্য সেনের অনুবাদ যে অর্থশাস্ত্র ও দর্শনের জটিল যোগের বিষয়টাকে সাধারণ পাঠকের নাগালের মধ্যে আনতে পেরেছে, তার প্রধান কারণ, শিবাদিত্য শুধু অমর্ত্য সেনই পড়েননি, এই সংক্রান্ত আলোচনার বৃহত্তর জগৎটা ছিল তাঁর বিচরণক্ষেত্র।

তা সত্ত্বেও নিজে তেমন কিছু লিখে গেলেন না কেন, কেন গবেষণামূলক কাজে হাত দিলেন না, তা বিস্ময়ের মনে হতে পারে, কিন্তু যাঁর জীবনই ছিল সাধারণের সাধনা, তাঁর কাছে এটাই ছিল স্বাভাবিক। ‘‘বড় কিছু করছেন না কেন, তাইরে নাইরে করে কাটিয়ে দিচ্ছেন’’— অনুযোগের উত্তরে বলেছিলেন, “বড় বলতে কী বুঝি? আমি যা করতে চাই তা-ই করতে চাইছি, এর চেয়ে বড় ব্যাপার আর কী আছে? কোটি কোটি লোকের কাছে তো বেছে নেওয়ার মতো কিছু নেই, তাদের ওপর যা চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটাই তাদের বয়ে বেড়াতে হয়; আমাকে তো তা করতে হচ্ছে না!” কথার কথা নয়, এটা তিনি বিশ্বাস করতেন। সে ভাবেই অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করতেন। এক বন্ধুর মুখে গল্প শুনেছি: “শিক্ষার অধিকার আইনের কোনও বাংলা ছিল না। ভয়ে ভয়ে শিব-দাকে ধরা হল, ওঁর আঠারো মাসে বছরের কথাটা সবাই জানে। আশ্চর্য, নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগেই তর্জমাটা দিয়ে দিলেন। একই অভিজ্ঞতা আইসিডিএস নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলোর বাংলা করার ব্যাপারে। কাজটাতে এক দিনও দেরি হয়নি।” এই কাজটাতে কেন দেরি হল না, তার উত্তরে কিছু বলেননি, মৃদু হেসেছিলেন।

কোনটা জরুরি, তা ঠিক করার ব্যাপারে তাঁর সাধারণত্বের একটা ভূমিকা ছিল। সভাসমিতিতে খুব একটা তাঁকে দেখা যেত না। হয়তো দেখা দিয়েই কেটে পড়লেন। কিন্তু যেখানে সাধারণ মানুষের চাহিদা ও দাবির ব্যাপার, যেখানে মানবমর্যাদার অবমাননার প্রশ্ন, তা সে গুজরাত গণহত্যা হোক বা শিবপুর মৌজার কৃষকদের জমি-অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আন্দোলনই হোক, তিনি সাগ্রহে উপস্থিত থাকতেন।

রসবোধ ছিল অসামান্য। গায়ের ছোপ ছোপ জামা নিয়ে কেউ আওয়াজ দিল, “কী ব্যাপার শিবদা? হঠাৎ এত রঙিন?” চোখের পাতা ফেলতে না ফেলতে উত্তর, “বয়স বাড়লে লাম্পট্যে পায়!” এও সেই অসাধারণ সাধারণতা: নিজেকে নিয়ে মজা করা! ক্যানসার ধরা পড়ে মার্চের গোড়ায়। চিকিৎসা চলছিল। অগ্রাধিকার-সচেতন মানুষটি জন্ম তারিখ জুনের ১০-এ নিজের ফেসবুক পাতায় তাঁর কেটে পড়ার অগ্রাধিকার নিয়ে লিখলেন, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে, “যা কিছু নিয়ে চলি শেষ সঞ্চয়/সুখ নয় সে দুঃখ সে নয়, নয় সে কামনা”। বাক্‌সংযমে বিশ্বাসী মানুষটি গানের শেষ পঙ্‌ক্তিটা কেন উদ্ধৃত করেননি, জিজ্ঞাসা করলে হয়তো তেমনি মৃদু হেসে বলতেন, ‘লোকে বুঝে নেবে।’’ এমন শিবাদিত্যরা, যাঁরা শুধু শোনেন, ‘‘মাঝির গান আর দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে’’, তাঁদের সাধারণত্বই মানুষকে অসাধারণ করে।

ছবি:অভ্র বসু

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Amartya Sen Translation Book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE