Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
কলকাতার লুপ্ত চিত্রগৃহদের ফসিলও রেখে যাব না আমরা

‌ম্লান হয়ে এল

নাটকেরই মতো, ছায়াছবির সমষ্টিগত স্মৃতিও দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তার স্থানিকতার সঙ্গে ওতপ্রোত ছিল। দেখা ছবির সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকত যে হল-এ ছবিটি দেখা হয়েছে, তার স্মৃতি। নিউ এম্পায়ারের সঙ্গে দর্পণা, কিংবা যমুনার সঙ্গে অরুণার রূপরসগন্ধের তফাত কাউকে বলে বোঝাতে হত না।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

কালের প্রবাহে পরিবর্তনই একমাত্র অবিচল, জানা কথা! কিন্তু কী এল-কে বুঝতে গেলে কী গেল-কে বুঝতে হয়। বিগত দু’দশকে এ শহরে যত সাবেকি প্রেক্ষাগৃহ ঝাঁপ ফেলেছে, তা নিয়ে হাহুতাশ হয়েছে বিক্ষিপ্ত। কিছু হল-কে বাঁচানোর উদ্যোগ হয়েছে। কিছু হল এখনও বাজারে টিকেও রয়েছে। জেলার ছবিও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। মাঝখান থেকে মাল্টিপ্লেক্স এসে সাবেকি সিনেমা হলগুলো বুড়ো বয়সে একটা নতুন নাম পেয়েছে— সিঙ্গল স্ক্রিন। কিন্তু মাল্টিপ্লেক্স মানে তো শুধু একটা পর্দার জায়গায় চারটে পর্দা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক সংস্কৃতি এবং সিনেমার সঙ্গে দর্শকের সংযোগে একটা বড় বাঁক বদল।

নাটকেরই মতো, ছায়াছবির সমষ্টিগত স্মৃতিও দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তার স্থানিকতার সঙ্গে ওতপ্রোত ছিল। দেখা ছবির সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকত যে হল-এ ছবিটি দেখা হয়েছে, তার স্মৃতি। নিউ এম্পায়ারের সঙ্গে দর্পণা, কিংবা যমুনার সঙ্গে অরুণার রূপরসগন্ধের তফাত কাউকে বলে বোঝাতে হত না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যে লিখছেন, ‘‘ছানাপট্টির ওই হল-এ (রূপম), তিন আনার সিটে বসে, ছারপোকার কামড় খেতে খেতে আমি যে দু’টো ছবি দেখেছিলুম, তার একটা হল টকি অব টকিজ...অন্য ছবিটি চন্দ্রগুপ্ত (নীরবিন্দু)’’; বা সুকুমার সেনের কলমে, ‘‘সবচেয়ে ভাল সিনেমা হল ছিল পিকচার প্যালেস।...প্রত্যেক শুক্রবার শুধু কমিক ফিল্ম দেখানো হত (দিনের পরে দিন যে গেল)’’— এ কোনও ব্যতিক্রম নয়। দর্শক মাত্রেই এমন স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করতে পারবেন। এক একটা হল-এর নাম উচ্চারিত হওয়া মাত্র সেই বাড়িটি, সামনের রাস্তা, বাদাম-চানাচুর বিক্রেতা, ব্ল্যাকারদের হাঁক, এই সব কিছু মনের মধ্যে আছড়ে পড়বে।

সিনেমাকে কেন্দ্র করে যে সামাজিকতা, সেটা তো পর্দায় দেখা গপ্পোটুকু নয়, সিনেমার হয়ে ওঠা থেকে শুরু করে দর্শকের দরবারে পৌঁছনোর প্রতিটি ধাপ আর তাকে স্মরণে রাখার প্রক্রিয়াও বটে। ছবি মুক্তির দিনে হলের সাজসজ্জা, মালার পাহাড়ে ঢেকে যাওয়া কাটআউট, তাসাপার্টির জগঝম্প— ভারতীয় ছবির সাংস্কৃতিক ইতিহাস এ সব বাদ দিয়ে নয়। গণেশ টকি, খান্না বা লোটাস অনায়াসে বাসস্টপে পরিণত হয়েছিল, ধর্মতলায় কারও সঙ্গে দেখা করতে হলে মোবাইল-পূর্ব যুগে অন্যতম ঠিকানা ছিল মেট্রোর সামনেটা।

মাল্টিপ্লেক্সে ঘটনাগুলো আর এ রকম ভাবে ঘটা সম্ভব না। তার কারণ এ রাজ্যে অন্তত বেশির ভাগ মাল্টিপ্লেক্সই ঢুকে গিয়েছে শপিং মল-এর ভিতরে। মল-এর নামেই হল-এর পরিচয়। মল-এ আর পাঁচটা দোকানের মতোই সিনেমার দোকান, জামাকাপড় আর খানাপিনার সঙ্গেই সেখানে সিনেমা ‘কিনে’ চলে আসতে হয়। ছবি-ঘরের পরিসরটাই এখানে আর পাঁচটা পণ্যের সঙ্গে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।

আরও একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে দর্শকের শ্রেণিচরিত্রে। মাল্টিপ্লেক্সের টিকিটের দাম মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের কথা ভেবেই বাঁধা। দক্ষিণ দিল্লির মাল্টিপ্লেক্স আর বহরমপুরের মাল্টিপ্লেক্সের টিকিটের দামে তফাত অবশ্যই আছে। কিন্তু দুটোই নিজ নিজ মহল্লার মধ্যবিত্ত ক্রয়ক্ষমতাকে মাথায় রেখেছে। সিনেমা হল এটা করত না। ফ্রন্ট স্টল থেকে ড্রেস সার্কল, নানা কিসিমের টিকিট নানা শ্রেণির দর্শকের জন্য রাখা থাকত। হাউসফুল শো ভাঙলে পিলপিল করে বেরিয়ে আসত একটা অণু-সমাজ, যার মধ্যে সকলের জন্য জায়গা আছে। রূপবাণীতে ছবি দেখার বর্ণনা নজরুলের কবিতায়, ‘‘হিন্দু মুসলমানের এমন মিলন দেখিনি আর/ বিড়িওলা আর অফিসের বাবু হয়ে গেছে একাকার (ট্রেড শো)।’’ মাল্টিপ্লেক্সে ঢোকা মানে চার পাশে একটাই শ্রেণিকে দেখতে পাওয়া— যেন বড় পৃথিবীর মধ্যে আর একটা ছোট পৃথিবী।

বস্তুত ছবি-ঘরের ক্রমপ্রস্থান আর মাল্টিপ্লেক্সের আগমনে বড় পর্দাই ক্রমশ নিম্নবিত্তের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অতীতে শুধু যে টিকিটের দামই নানা স্তরকে ছুঁতে চেয়েছে তা-ই নয়, প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা আর বিন্যাসেও ‘সবারে করি আহ্বান’ মন্ত্রটি নিহিত ছিল। শহরের গরিব তল্লাটেও হাতের নাগালে পাওয়া যেত কোনও চিত্রগৃহ। নামী চেনগুলোর পাশাপাশি ছড়িয়ে থাকত অজস্র তথাকথিত দ্বিতীয় শ্রেণির হল। সে সবের কিছু টিকে আছে, অনেকগুলোই নেই। এ কালে নিম্নবিত্তের বড় অংশই আর খুব হল-এ যায় না। টিভি আর স্মার্টফোনের গণতন্ত্রই তার বিনোদনের চাহিদা মেটায়।

এই দু’টি যন্ত্র অবশ্য, মধ্য বা উচ্চবিত্ত হলে সঙ্গে যোগ হবে ল্যাপটপও— সারা পৃথিবীতেই প্রেক্ষাগৃহের সামনে এক মস্ত চ্যালেঞ্জ। সাবেকি সিনেমা হল-এর সঙ্কট শুধু কলকাতার নয়, শুধু ভারতের নয়, বিশ্ব জুড়েই ছবিটা কমবেশি এক। ব্রিটেনে, আমেরিকায় প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে, এমন খবর বিরল নয়। নেটফ্লিক্স এসে সিনেমার মৃত্যুঘণ্টা বাজবে কি না, সে আলোচনা কিছু দিন ধরেই চলছে। এ বার দর্শক যত বেশি করে টিভি-ল্যাপটপ-স্মার্টফোনে নিবিষ্ট হবেন, সিনেমা তত বেশি করে ব্যক্তিগত বিনোদন হয়ে উঠতে থাকবে। মজার দৃশ্যে হলভর্তি মানুষ একযোগে হেসে উঠছে কিংবা সাসপেন্স-দৃশ্যে গোটা হল দমবন্ধ করে রয়েছে— এর মধ্য দিয়ে যে যৌথ একাত্মতার অনুরণন তৈরি হয়, সেটা ক্ষইতে থাকবে। এখনই সিনেমা আক্ষরিক অর্থে হাতের মুঠোয় চলে এসে পর্দায় ছবি ফুটে উঠতে দেখার শিহরন ম্লান হয়ে আসছে। এমতাবস্থায় বড় পর্দা যত বেশি করে মাল্টিপ্লেক্সকেন্দ্রিক হচ্ছে, তত বেশি করে সেটা একটা বিশেষ শ্রেণিতে আটকে যাচ্ছে।

মধ্যবিত্তের সিনেমা-দর্শনও কি পাল্টাচ্ছে না? প্রেক্ষাগৃহে যাওয়ার ঝোঁক তারও কমেছে প্রভূত পরিমাণে। যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যেও রিপিট-প্রবণতা আর নেই বললেই চলে। কারণ তার সামর্থ্য আর প্রয়োজন, দুইই ফুরিয়েছে। ফিরে দেখার জন্য টিভি, ইন্টারনেট আছে! ১৫ বার ‘সাগরিকা’ কি ২৬ বার ‘শোলে’ দেখে আসার মহৎ কীর্তি এ যুগে আর স্থাপিত হওয়া দুষ্কর।

অঞ্চলভেদে কিছু তারতম্য নিশ্চয় আছে। যেমন নয়-নয় করে শুধু চেন্নাইতেই এখনও একশোরও বেশি হল চালু রয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে মূলত দুটো কারণে। এক, দক্ষিণী সমাজে সিনেমার গরিমাই আলাদা। সেখানে দর্শক এখনও হলমুখী। দুই, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ভাষাগত সুবিধার কারণে এক সঙ্গে চারটি ভাষার ছবি চলে। ফলে ব্যবসার আয়তনও অনেক বড়।

এর পাশে কলকাতার দিকে তাকানো যাক। নব্বইয়ের দশকেও এ শহরে বাংলা আর হিন্দি ছবির আলাদা চেন ছিল। কিছু হল নির্দিষ্ট ছিল হলিউডি ছবির জন্য। দ্বিতীয় শ্রেণির হলগুলিতে চলত বি-মুভি, কিছু ভোজপুরি ছবি আর বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঘুরিয়েফিরিয়ে পুরনো ছবি, মূলত হিন্দি। প্রথম ধাক্কাটা এল ভিডিয়ো ক্যাসেট আর স্যাটেলাইট চ্যানেলের দৌলতে। সপ্তাহান্তিক দূরদর্শনের বাঁধা ছবি ছাড়া সিনেমা দেখতে চাইলে হল-এই দৌড়ে যেতে হবে, এই বাধ্যবাধকতা আর রইল না। টিভি ক্রমেই মধ্যবিত্তের বৈঠকখানা ছাড়িয়ে বস্তির খুপরি অবধি পৌঁছে গেল। অন্য দিকে শহুরে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ নানা কারণে মূল ধারার বাংলা ছবি থেকে আকর্ষণ হারাল। এখন সেই মধ্যবিত্তেরই আধখানা শহরছাড়া। বাকি আধখানা, বাংলা ছবিই হোক বা হিন্দি কি ইংরেজি, দু’একটা হল বাদ দিলে মূলত মাল্টিপ্লেক্সে ভিড় জমায়। এই অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে হল চালানোর চেয়ে রিয়েল এস্টেট বা রিটেলারদের হাতে চাবি চলে যাবে, তাতে আশ্চর্য কী! এ রাজ্যে এক সময় হুহু করে হল তৈরি হয়েছে— ১৯২৮-এ অবিভক্ত বাংলায় ৪৫টা হল ছিল, পরের দু’দশকে সেটা বেড়ে হয়েছিল ৪০৪। এখন হাওয়া উল্টো দিকে।

সম্প্রতি এলিট-এর ঝাঁপ ফেলে হলমালিক যে জানালেন, মে মাসের শেষ সপ্তাহে একটা টিকিটও বিক্রি হয়নি, তার প্রেক্ষাপটটি দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি হয়েছে। ধর্মতলা চত্বরের আগের জৌলুস আর নেই। বাইপাস আর মেট্রোর কল্যাণে শিয়ালদহ তল্লাটে যাওয়ার প্রয়োজন অনেকেরই ফুরিয়েছে। উত্তর কলকাতার চরিত্রও বদলে যাচ্ছে। নগরায়ণের প্রসার, জনবিন্যাস আর ভরকেন্দ্রের পরিবর্তনও তাই বেশ কিছু হল-এর মৃত্যুর কারণ। পৌষমাস এখন পুরনো পোস্টার-লবি কার্ডের কারবারে। একটা করে হল-এ তালা ঝুলছে আর তার জিম্মায় থাকা ‘কালেক্টিবল’ সটান চলে আসছে কিউরিয়োর বাজারে।

আক্ষেপের কথা হল, শো-হাউসে ঝাঁপ পড়া মানে শুধু ক’টা বাড়ি বাতিল হয়ে যাওয়া নয়। সিনেমা এবং সিনেমা দেখার ইতিহাসটাই অনেকাংশে মুছে যাওয়া। কলকাতার বুকে ছবি দেখানোর প্রথম স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান ছিল এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেস (পরে মিনার্ভা/চ্যাপলিন)। বাংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’ (১৯১৯) দেখানো হয়েছিল শ্রী-তে (তখন কর্নওয়ালিস থিয়েটার)। বাঙালির তৈরি প্রথম চিত্রগৃহ রসা থিয়েটার (পরে পূর্ণ) প্রথম ছবি দেখায় ১৯২১ সালে, ‘বিলেতফেরত’। ভারতে প্রথম সবাক ছবি দেখানো হয় ১৯২৭ সালে, গ্লোবে। বাংলার প্রথম সবাক ছবি ‘জামাইষষ্ঠী’ (১৯৩১) মুক্তি পায় উত্তরায় (তখন নাম ক্রাউন)।

একটাও আর নেই কিন্তু। কিছু গুঁড়িয়েই গিয়েছে, কিছু দিন গুনছে। কাঠামোগুলো রেখে তাকে অন্য ভাবে ব্যবহার করা যায় কি না, কোনও ফলক অন্তত বসিয়ে রাখা উচিত কি না, আমরা ভাবিনি। আমরা শুধু কালের স্রোতে গা-ই ভাসাইনি, ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করতে করতে গিয়েছি। মাটি খুঁড়লে ডাইনোসরেরও ফসিল মেলে। কলকাতার লুপ্ত চিত্রগৃহেরা সে কপাল করে আসেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cinema Hall Extinct Single Screen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE