Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

হিমা, এ সবে কান দেবেন না

আসলে আমাদের দেশে তৈরি খেলোয়াড় নিয়ে মাতামাতির অন্ত নেই। কিন্তু খেলোয়াড় তৈরি? সে ওই দু’এক জন নিপন দাস করে দেবেন! হিমা তো ফুটবলারও হতে পারতেন! পারেননি। হিমা একটি ভাল স্পাইকই জোগাড় করতে পারেননি কিছু দিন আগেও। কিন্তু তাতে তো আমাদের ক্রীড়াজগতের কেষ্টবিষ্টুদের কোনও লজ্জা নেই! তাঁদের কেবল লজ্জা হয়, হিমা বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে ঠিকমতো ইংরেজি বলতে না পারলে।

হিমা দাস

হিমা দাস

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

কৃষ্ণাঙ্গী অষ্টাদশীর দৃপ্ত পা ভিকট্রি পয়েন্ট ছুঁয়ে ফেলল। এখন তাঁর সারা গায়ে ভারতবর্ষ। এখন তাঁর ঠোঁটের কোণে ভারত হাসছে। এখন তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল দৃষ্টি, গলার মেডেলে ভারত ঝলকাচ্ছে। এখন কি আমরা তাঁর জন্য গর্ব করতে পারি? না, পারি না। কারণ তিনি দৌড়তে পারেন, কিন্তু ভাল ইংরেজি বলতে পারেন না। সেমিফাইনালে ওঠার পর ‘ভারতীয় অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন’ ওঁর জয়ধ্বনির নামে ইংরেজি বলার অক্ষমতা নিয়ে কাঁচুমাচু মুখে টুইট করেছিল। আবার সেই পোস্টের সমর্থনে ওঁর সাক্ষাৎকারের ভিডিয়ো পর্যন্ত আপলোড করে দিয়েছিল। পরে অবশ্য ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু যদি উনি সোনা না পেতেন?

হিমা দাস অসমের এক কৃষক পরিবারের মেয়ে। তাঁর বাবা আক্ষরিক অর্থেই ‘দুই বিঘা জমি’র মালিক। তাঁরা চার ভাইবোন কষ্টে বড় হয়েছেন। হিমা ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। এ দেশ হালে ক্রিকেটে তবু মেয়েদের কিছুটা গ্রহণ করেছে। তাই বলে কৃষকের মেয়ের ফুটবল বিলাস? নৈব নৈব চ! কাজেই বল নিয়ে মাঠ দাপানো হল না; কিন্তু এক দরদি শিক্ষকের ভালবাসায় দৌড় হল। সস্তা স্পাইক পরে দৌড়ে সোনা পেয়ে হিমা নজরে পড়ে গেলেন অসমের ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ দফতরের অ্যাথলেটিক্স কোচ নিপন দাসের। বিশ্বমঞ্চে তিনি পা রেখেছেন মাত্র এক বছর। আর তাতেই ফিনল্যান্ডে অনূর্ধ্ব কুড়ি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ-এ ৪০০ মিটারের ট্র্যাক ইভেন্টে সোনা। হিমা ভারতের প্রথম মেয়ে, যিনি অ্যাথলেটিক্সে বিশ্ব স্তরে স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। তবু এ দেশের ক্রীড়াজগতের কর্তারা তাঁর মধ্যে ভবিষ্যতের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে না খুঁজে ‘স্পোকেন ইংলিশ’ খুঁজছেন। আর আমাদের কানে বাঙালির ভালবাসার সেই শব্দ ক’টি অনুরণিত হচ্ছে, “ফাইট কোনি, ফাইট!”

হিমা দাসের গল্পে ‘খিদ্দা’ আছেন কি না, জানা নেই। ‘কোনি’ অবশ্যই আছে। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বলে উঠেই নিভে যান যে অসংখ্য পুরুষ বা মহিলা খেলোয়াড়, তাঁদের অনেকেই হয়তো এক জন ‘খিদ্দা’ পেলে কোনি হতে পারতেন। কিন্তু এ দেশের ক্রীড়াজগতের কর্তাদের মধ্যে ‘খিদ্দা’ হওয়ার ইচ্ছা কোথায়? তাঁদের তো দলাদলি করতে হয়, ভোটে জিততে হয়, বিদেশ সফরে যেতে হয়; আর হ্যাঁ, ইংরেজি বলতে হয়। এই এত আড়ম্বরের মধ্যে আসল কাজে সাফল্যের চিত্রটি কেমন? ২০১৭ সালে লন্ডনে যে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ’ হয়ে গেল, তাতে আমাদের দেড়শো কোটির দেশ একটিও মেডেল পায়নি। ‘ট্র্যাক ইভেন্ট’-এ পুরুষ অ্যাথলিটরা কেউ ফাইনালেই উঠতে পারেননি। মহিলাদের ‘ম্যারাথন’-এ তবু উঠেছিলেন। এক জন দ্বাদশ এবং অন্য জন বিয়াল্লিশতম হয়ে শেষ করেছেন। আর অলিম্পিক্স? ২০১৬ সালে রিয়ো অলিম্পিক্সে ভারত যে বিশাল দল পাঠিয়েছিল, তাতে মহিলা ছিলেন পঞ্চাশ জন। ক’টি পদক ঘরে এসেছিল? মাত্র দু’টি।

আসলে আমাদের দেশে তৈরি খেলোয়াড় নিয়ে মাতামাতির অন্ত নেই। কিন্তু খেলোয়াড় তৈরি? সে ওই দু’এক জন নিপন দাস করে দেবেন! হিমা তো ফুটবলারও হতে পারতেন! পারেননি। হিমা একটি ভাল স্পাইকই জোগাড় করতে পারেননি কিছু দিন আগেও। কিন্তু তাতে তো আমাদের ক্রীড়াজগতের কেষ্টবিষ্টুদের কোনও লজ্জা নেই! তাঁদের কেবল লজ্জা হয়, হিমা বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে ঠিকমতো ইংরেজি বলতে না পারলে।

ইংরেজি একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা। উপনিবেশবাদ এবং অন্যান্য কারণে এখন সারা পৃথিবীর সাড়ে সাতশো কোটি মানুষের প্রায় কুড়ি শতাংশ ইংরেজি বলেন; কেউ প্রথম ভাষা, কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা হিসাবে। কিন্তু এ-ও তো সত্য যে, বাকি আশি শতাংশ মানুষ ইংরেজি জানেন না! তাতে কি তাঁদের লজ্জিত হতে হবে? যদি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষীর ব্যবহারের নিরিখে তৈরি তালিকাটি দেখা যায়, দেখব ইংরেজির চেয়ে চাইনিজ় এবং স্প্যানিশ উপরে রয়েছে। তা হলে কি হিমা দাসের এই কারণেও লজ্জা পাওয়ার ছিল, যে তিনি চাইনিজ় বা স্প্যানিশ জানেন না? এই প্রশ্ন এক জন ইংরেজের মনে কখনও দেখা দেবে না। দেখা দেবে সেই সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির অধিকারী কূপমণ্ডূকদের মনে, যাঁরা একটি ভাষার প্রয়োজন, মহত্ত্বকে উপলব্ধি করতে না পেরে কেবল তার জাঁকজমকে বরাত দিয়ে বসে থাকেন। তাঁরা না পারেন সেই ভাষাকে যোগ্য মূল্য দিতে, না পারেন নিজের ভাষা বা জাতির সম্মান রক্ষা করতে।

ভারত বহু ভাষাভাষী মানুষের দেশ। তার উপর ইংরেজ এখানে দু’শো বছর ছিল। কাজেই চাই বা না চাই ইংরেজি আমাদের প্রয়োজন ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাই বলে কেউ যদি ইংরেজি না বলতে পারেন, তা হলে তাঁর কোনও দামই থাকবে না, বেঁচে থাকাই ব্যর্থ হয়ে যাবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কার আছে? হিমা দাসই প্রথম নন। বাংলাদেশের ক্রিকেটার শাকিব আল হাসান, পাকিস্তানের ক্রিকেটার মোহাম্মদ হাফিজ়-সহ অনেককে নিয়েই আমাদের তৃতীয় বিশ্ব উপহাসের ঝড় তুলেছিল। কারণ তাঁরা ভাল করে ইংরেজি বলতে পারেননি। আসলে এই সমালোচকরা ভাষাকে প্রয়োজন হিসাবে দেখেন না, দেখেন ‘স্টেটাস’ হিসাবে। আর এই দৃষ্টিকোণের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাঁদের খেলোয়াড় তৈরির ব্যর্থতার মূল কারণটি। আমাদের ক্রীড়াজগতে বড় বড় বাড়ি, সাজানো অফিস, প্রেস কনফারেন্স, প্রচুর আলোচনা, বাজেট বিতর্ক, গদির লড়াই, স্বজনপোষণ, সব আছে। কিন্তু ‘তোতাকাহিনী’র সেই সোনার খাঁচার মধ্যে “পাখিটার খবর কেহ রাখে না!” মেসি, রোনাল্ডো, নাদাল, মারাদোনাদের কেউ প্রশ্ন করে না, এঁরা ইংরেজি কেমন বলেন। জানতে চাওয়া হয়, কেমন করে তাঁরা তৈরি হলেন? কোন অ্যাকাডেমিতে তাঁরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন? তাঁদের ডায়েট চার্ট কী? তাঁরা জিমে কী কী করেন? আর আমাদের হিমা দাসরা জিম তো দূর অস্ত্, খেলার কোনও মাঠই পান না, প্রশিক্ষক কী তা-ই জানেন না, ‘ডায়েট চার্ট’-এ পান্তা জোটে কি না সন্দেহ। তবু এই দৈন্যের মধ্যেও তাঁরা স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখেন, পরিশ্রম করেন, হেরে যান, হয়তো কেউ কেউ সফলও হন। আর তখনই প্রশ্ন ছুটে আসে: “আপনি ইংরেজি বলতে পারেন?”

হিমা, এ সবে কান দেবেন না। আপনার সাফল্যের দিকে চেয়ে আছি আমরা সবাই, গোটা ভারত। এই সব ছোট কথা কি আপনার মতো বড় মানুষদের দৌড়ের সামনে এসে দাঁড়াতে পারে? আপনাকে অনেক অভিনন্দন! আপনি এগিয়ে যান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE