আমাদের দেশের ইতিহাস চর্চার একটা মূল সমস্যা হচ্ছে এখানে ইতিহাস আর মিথ বা কিংবদন্তি এমন ভাবে জড়াপুটলি বেঁধে আছে যে, কোনও ঘটনাগুলো আদপে ঘটেছিল আর কোনটা লোককল্পনা— বোঝা ভার। এই সম্পর্কে ‘নদিয়া কাহিনি’র লেখক কুমুদনাথ মল্লিক বড় মোক্ষম বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশে অন্যান্য বিষয়ে যতই উন্নতি হউক না কেন ইতিহাসের চর্চা যে কখনও বহুল পরিমাণে হইয়াছে, বলিয়া অনুমিত হয় না। যাহা কিছু ইতিহাস বলিয়া সাধারণত প্রচলিত আছে, তাহা এতই অদ্ভুত ও অলৌকিক কাহিনিতে সমাচ্ছন্ন যে, তাহার মধ্য হইতে খাঁটি সত্যটুকু বাছিয়া লওয়া সুকঠিন; আর তাহা বাছিয়া লইতে গেলেও ইথিহাসের সঙ্গে অনেক ক্ষত হইয়া পড়ে”। তাই জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্ভব ও তার ইতিহাস নিয়ে কিছু বলতে গেলে কুমুদনাথের মতো একই সমস্যায় পড়তে হয়।
প্রচলিত আছে বঙ্গদেশে অন্নপূর্ণা আর জগদ্ধাত্রী পূজা নাকি নদিয়াধিপতি অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে শুরু হয় বা তাঁর রাজত্বকালেই এর ব্যাপক প্রচলন হয়। অন্নদাপুজোর ব্যাপারটা নয় ভারতচন্দ্রের মঙ্গলকাব্য থেকে অনুমান করা গেল, কিন্তু জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়টা কখন? অনেকে বলেন, সেটা নবাব আলিবর্দির আমল কিন্তু সেটা কিছুতেই সম্ভব না। বরং কিছুটা সারবত্তা আছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা স্বনামধন্য দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত’এর অনুমানে, মিরকাশিমের মুঙ্গের কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুক্তিলাভের জন্য ভান করে রাজা নাকি এই দেবীর পূজা করতে বসেছিলেন। আরও এক মতানুসারে, রাজা নাকি দেবীর স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত হন মিরকাশিমের হাজত থেকে মুক্ত হয়ে নৌকাযোগে ফেরার পথে।
এই মুক্তি পাওয়ার গল্পে দেবীমহিমার কতটা হাত আছে, তা ভগবান জানেন। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনাশ্রিত উপন্যাস লেখার জন্য ওই সময়ের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে ইঙ্গিত পেয়েছি, সময়কালটা ১৭৬৩ সাল। সেই সময়ের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর হেনরি ভ্যান্সিটার্ট, যিনি প্রায় নিজ দায়িত্বে মিরজাফরকে সরিয়ে তখ্তে বসিয়েছিলেন মিরকাশিমকে। কিন্তু নবাব হওয়ার পর নানা কারণে মিরকাশিম বেঁকে বসলেন আর পলাশির চক্রান্তের শাস্তি দেওয়ার জন্য একের পর বন্দি ও খুন করতে লাগলেন ইংরেজ ঘনিষ্ঠ ষড়যন্ত্রী রাজন্যদের। নবাবের প্রতিশোধ প্রবণতায় ছাড় পেলেন না তৎকালীন জগৎ শেঠ মহাতাব রায় ও মহারাজা স্বরূপচন্দ, ঢাকার নায়েব রাজবল্লভ সেন প্রমুখ। যুবরাজ শিবচন্দ্র সহ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটক করা হল বিহারের মুঙ্গেরের কয়েদখানায়। এ দিকে ২ অগস্ট গিরিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে হেরে মিরকাশিমের সব রাগ গিয়ে পড়ল তাঁর আর্মেনিয়ান সেনাপতি গর্গিনখাঁয়ের ( বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস চন্দ্রশেখরের চরিত্র গুরগনখাঁ, আর্মেনিয়ান নথি ঘাঁটতে গিয়ে পেয়েছি আসল নাম খোয়াজা পেট্রাস গ্রেগরি) উপর। গর্গিনখাঁকে হত্যা করানোর পর হননের নেশায় পেয়ে বসল নবাবকে, আরও কয়েকজনকে প্রাণদণ্ড দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হল নদিয়ারাজেরও। কিন্তু সেই ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরেও রাজা কী করে প্রাণে বেঁচে ফিরলেন, সেটা রীতিমত রহস্যময় ব্যাপার।
অনুমান সেই বছরের সেপ্টেম্বর মাসের পাঁচ কি ছয় তারিখ, উদয়নালার যুদ্ধে ইংরেজবাহিনীর কাছে আবার হেরে মিরকাশিম রোহতাসগড় দুর্গের দিকে পালালে কিছু সপ্তাহের ভিতর ইংরেজবাহিনী মুঙ্গের দুর্গের দখল নেয় এবং কৃষ্ণচন্দ্র ও শিবচন্দ্রকে উদ্ধার করে। পালানোর আগে অবশ্য মিরকাশিমের আদেশানুসারে জগঠ শেঠ মহাতব রায়, স্বরূপচাঁদ, রাজবল্লভ সেন প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের গঙ্গার জলে ডুবিয়ে হত্যা করা হয় (নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনি)। কিন্তু ভাগ্য অত্যাধিক সুপ্রসন্ন থাকায় সে যাত্রায় কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণরক্ষা হয়। ধার্মিক রাজা নিশ্চয়ই এ সবের পিছনে দেবীর অলক্ষ্য হাত দেখতে পান আর সেই কৃতজ্ঞতার বশেই তিনি আয়োজন করে বসেন দেবী জগদ্ধাত্রী আরাধনার।
তবে লোকশ্রুতিতে গল্পটি আর রাজার মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার সময়কাল কিঞ্চিত আলাদা। সুধীর চক্রবর্তী তাঁর ‘উৎসবে মেলায় ইতিহাসে’ নদিয়ার হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো সেই বিশ্বাসকে ভাষা দিয়েছেন এই ভাবে যে, “যখন কারাগার থেকে মুক্ত হলেন রাজা তখন আশ্বিন মাস। এখানে দুর্গাপূজা। বিজয়াদশমীর বিকালে পৌঁছলেন নদিয়ার রুকুনপুর ঘাটে। শ্রান্ত আশাহত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ঢলে পড়লেন ঘুমে। তারপরেই সেই স্বপ্ন। তবে স্বপ্নের সেই দেবীমূর্তি দুর্গা নন, অথচ ত্রিনয়নী চারহাত রক্তাম্বরধারিণী। সাদা নরসিংহে যোদ্ধার মতো বসে আছেন। দুই হাতে শঙ্খচক্র আর দুই হাতে ধনুর্বাণ। স্বপ্নে দেবীর প্রত্যাদেশ হল: সামনের শুল্কা নবমীতে একইদিনে সপ্তমী-অষ্টমী-নবমীপূজা করলেই দুর্গাপূজার অনুকল্প হবে। রাজা তাই করলেন। সেই থেকে কৃষ্ণনগরে চালু হল জগদ্ধাত্রীর পূজা।”
কিন্তু কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী তাঁর ‘নবদ্বীপ মহিমা’য় স্পষ্টই বলেছেন, কৃষ্ণচন্দ্রের পপৌত্র মহারাজা গিরিশচন্দ্রের (রাজত্বকাল ১৮০২-১৮৪১) পূর্বে আমাদের বঙ্গদেশে জগদ্ধাত্রীপুজার প্রচলন ছিল না। “উক্ত মহারাজের যত্নে তন্ত্র হইতে ওই মূর্তি প্রকাশিত হয়। শান্তিপুরের নিকটবর্তী ব্রহ্মশাসন গ্রামনিবাসী চন্দ্রচূড় ন্যায়পঞ্চানন নামক জনৈক তন্ত্রশাস্ত্র বিশারদ পণ্ডিতকর্তৃক এই মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। পরে নবদ্বীপের পণ্ডিতগণের অনুমোদিত হইলে ওই মূর্তির পূজা আরম্ভ হয় ।” গিরীশচন্দ্র নিজে যেহেতু ছিলেন তন্ত্রচর্চাকারী রাজা আর দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপ বিবর্তনে যেহেতু তন্ত্রের প্রভাব স্পষ্ট (জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায় “মায়াতন্ত্র” ও কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ‘তন্ত্রসার’, এমনকি বেশ কিছু বৌদ্ধতন্ত্রেও) তাই কান্তিচন্দ্র রাঢ়ীর দাবিকে কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনও হতে পারে, জগদ্ধাত্রী পুজো সর্বজনীন অর্থে পূর্বপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে শুরু হলেও তার জাঁকজমক ও শ্রীবৃদ্ধি হয় রাজা গিরীশের আমলে।
আসলে নদিয়ার আঠারো শতকের ইতিহাসে কৃষ্ণচন্দ্র এমনই এক সর্বগ্রাসী চরিত্র যে, সেই সময় উল্লেখযোগ্য যাই ঘটেছে প্রায় সব কিছুর সঙ্গে নাম জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর নাম। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা ভুলে গিয়েছি হিন্দু ব্রাহ্মণ্য সাকার আরাধনার আরও বড় পৃষ্ঠপোষক মহারাজা গিরীশকে। গিরীশচন্দ্রও কিন্তু শিল্পসংস্কৃতির কম বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। তাঁর আমলেই দিল্লির বিখ্যাত কালোয়াত কায়েম খাঁ আর তাঁর তিনপুত্র মিয়া খাঁ, হম্মু খাঁ ও দেলাওর খাঁ কৃষ্ণনগর রাজদরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এবং তাঁর সভাতেই রাজপরিকর হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন রসরাজ কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy