শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টই ভরসা! কর্নাটকে বিধানসভা নির্বাচনের পর গণতন্ত্রের আব্রু যে রক্ষা পেয়েছে, তার কৃতিত্ব সাধারণ মানুষ দেশের সর্বোচ্চ আদালতকেই দিচ্ছেন। সত্যিই, গণতন্ত্রের সম্মান বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্টের অবদান, আবারও মোক্ষম। আদালত যদি এতখানি সক্রিয় না হত, তবে বিধায়ক আর ঘোড়ার মধ্যে ফারাক করা মুশকিল হত। কিন্তু প্রশ্ন হল, যে পরিসর নীতির বা রাজনীতির, সেখানে কেন আদালতকে বারে বারে হস্তক্ষেপ করতে হয়? সেই হস্তক্ষেপটি কি ভারতীয় সংবিধানের দার্শনিক অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ?
ভারতে বিচারবিভাগের প্রাথমিক দায়িত্ব আইনের ব্যাখ্যা করা, আইন তৈরি করা নয়। আইন তৈরি করার দায়িত্ব আইনবিভাগের, সেই আইন প্রয়োগ করার দায়িত্ব শাসনবিভাগের। দায়িত্বের এই বিভাজনই ভারতে ক্ষমতা-ভাগের নীতির অঙ্গ। কিন্তু ১৯৭০-এর দশক থেকেই দেখা গিয়েছে, ভারতের বিচারবিভাগ এই গণ্ডি অতিক্রম করে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে, যা এখন বিচারবিভাগীয় অতিসক্রিয়তা নামে পরিচিত। বিশেষত জরুরি অবস্থার পর— যখন থেকে সরকারের প্রতি মানুষের অনাস্থা ও অবিশ্বাস ক্রমে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে— সাধারণ মানুষের চোখে বিচারবিভাগ অনেক বেশি মানবিক ও বিশ্বাসযোগ্য, এবং অতি অবশ্যই, রাজনৈতিক শ্রেণির চেয়ে ঢের কম ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
আদালতও সাধারণ মানুষের আস্থার মর্যাদা রক্ষা করেছে। জনস্বার্থ মামলার মতো পথে আদালত মানুষের আরও কাছাকাছি এসেছে। অতঃপর, স্বাভাবিক অবস্থায় যে জিনিসগুলো সরকারের বিবেচ্য হওয়া উচিত, তার অনেকগুলোই পৌঁছতে আরম্ভ করেছে আদালতের দোরগোড়ায়। পরের বছর বইমেলা কোথায় হবে, বাঁধের সর্বোচ্চ উচ্চতা কোথায় বাঁধতে হবে, কোনও পরিষেবার মূল্য কী ভাবে স্থির করতে হবে— এমন হরেক প্রশ্নে আদালত আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের খুঁটিনাটি স্থির করে দেয় এখন। অনেক ক্ষেত্রে আমরা খেয়ালও করি না, কী ভাবে আদালতের নির্দেশ ছাপ ফেলছে আমাদের জীবনে।
বিচারবিভাগের প্রাথমিক কাজ আইনের পর্যালোচনা— কোনও আইন, বা শাসনবিভাগের কোনও কাজ সংবিধানের গণ্ডিকে অতিক্রম করছে কি না, বিচার করে দেখা। ভারতের প্রথা ছিল, যে ক্ষেত্রে সংবিধান অতি প্রবল ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে, শুধু সেই ক্ষেত্রেই বিচারবিভাগ এই পর্যালোচনা করবে। নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তকে প্রভূত গুরুত্ব দেওয়া হত, এবং খুব প্রকট ভাবে সংবিধানবহির্ভূত না হলে তাঁদের সিদ্ধান্তকে সংবিধানসিদ্ধ হিসাবেই গণ্য করা হত। সোশ্যাল কনট্র্যাক্ট বা সামাজিক চুক্তির দার্শনিক ধারা মেনেই বিশ্বাস করা হত, নির্বাচিত সাংসদরা, এবং সরকার, সাধারণ মানুষের ইচ্ছার, মতের, প্রতীক। কাজেই, কোনও মামলায় বিচার করার সময় নীতিগত বিষয় অথবা রাজনৈতিক প্রশ্নকে এড়িয়ে চলাই ছিল ভারতীয় বিচারবিভাগের প্রথা।
বিচারবিভাগের সেই সংযম এখন অতীত। খুব স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, কোনও প্রশ্নে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন, বিচারবিভাগীয় ছাড়পত্র পাওয়ার আগে কোনও নীতিই চূড়ান্ত নয়। ডিমনিটাইজ়েশন হোক বা আধার-এর ব্যবহার, নির্বাচনের দিন স্থির করাই হোক বা বিসিসিআই-এর প্রশাসনিক কাঠামো (মনে রাখা দরকার, বিসিসিআই প্রতিষ্ঠানটি নিতান্তই বেসরকারি), দেশের যে কোনও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই আদালতের পর্যবেক্ষণ বই গতি নেই।
সংবিধান রচয়িতারা বিচারবিভাগের কোনও ভূমিকার কথা ভাবেননি, এমন দুটো ক্ষেত্রের কথা বলি। এক, সংবিধানের ৭২ এবং ১৬১তম ধারায় যথাক্রমে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালদের হাতে কাউকে ক্ষমা করার অধিকার; দুই, সংবিধানের ৩৫৬ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার ক্ষমতা। দু’টি ক্ষেত্রেই ক্ষমতা প্রয়োগ বিষয়ে সিদ্ধান্তের অধিকার শাসনবিভাগের (সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করার প্রশ্নে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপাল সংশ্লিষ্ট সরকারের পরামর্শের দ্বারাই চালিত হন)। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্তগুলিও বিচারবিভাগের পর্যবেক্ষণের পরিধির মধ্যেই পড়ে। এবং, আদালত যদি মনে করে যে সিদ্ধান্তগুলি কোনও বাইরের কারণ, অবান্তর যুক্তি অথবা অন্যায় বাসনার দ্বারা প্রভাবিত, তবে শাসনবিভাগের সিদ্ধান্ত নাকচ করে দেওয়ার অধিকারও তার রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটা এক জটিল সমস্যার সহজ সমাধান। কিন্তু, কোনও সিদ্ধান্ত কোনও বাইরের কারণ, অবান্তর যুক্তি বা অন্যায় বাসনার দ্বারা প্রভাবিত কি না, সেই বিচারও কি নৈর্ব্যক্তিক হতে পারে?
একেবারে এক পরিস্থিতিতেও এক বিচারপতির থেকে অন্য বিচারপতির মত কি পৃথক হতে পারে না? প্রশ্নটা এখন আরও প্রাসঙ্গিক, কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও হরেক ফাটল প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
যদি দেখা যায় কোনও সরকার গণতন্ত্রের ধর্মে বিশ্বাসী নয়, অথবা দেশের মৌলিক চরিত্রটাই পাল্টে দিতে উদ্যত, গণতন্ত্রের রথের চাকাতেই সেই সরকার চূর্ণ হবে। কিন্তু, এখন সময়টা মারাত্মক। সরকার বিভিন্ন ভাবে বিচারবিভাগে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে— কখনও সুপ্রিম কোর্টে কিছু বিশেষ বিচারকের নিয়োগ আটকে দিয়ে, কখনও ন্যাশনাল জুডিশিয়ারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিটির মতো কিছু তৈরি করে। এই সময় যদি আমরা প্রতিটি সমস্যা নিয়ে বিচারবিভাগের দ্বারস্থ হই, তা হলে তা অচিরেই বিপরীত ফলদায়ী হতে পারে। মনে রাখা ভাল, ভারতের সংবিধান অনুসারে কোনও বিচারককে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া দুঃসাধ্য। কাজেই, সরকার যদি বিচারবিভাগে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দেওয়ার রাস্তা খুলে ফেলতে পারে, যদি ‘কমিটেড’ বিচারপতিরা ‘কমিটেড’ রায় দিতে আরম্ভ করেন, এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই বিচারবিভাগের শেষ কথা বলার প্রবণতাটি চলতে থাকে, গণতন্ত্রের পক্ষে তা সুসংবাদ হবে না।
সরকারের আস্থা ভোট ১৫ দিন পরে হবে না কি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই, এ রকম সিদ্ধান্তের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার চেয়ে ঢের ভাল নয় কি একটা নির্দিষ্ট নিয়মবিধি তৈরি করে নেওয়া, এই ধরনের পরিস্থিতিতে রাজ্যপালরা যে বিধি মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন? এই নীতিগত সিদ্ধান্ত নির্ধারণের অধিকার থাকবে সংসদের হাতেই। কিন্তু অতীতে সরকারিয়া কমিশন বা পুঞ্ছি কমিশনের ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ কমিশন তৈরি হয়েছে। এই রকম সিদ্ধান্ত করার জন্য এই গোত্রের যৌথ কমিশন তৈরি করাই যায়। বিচারবিভাগকে কেবল দেখতে হবে, কোনও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নির্ধারিত নিয়মবিধি ঠিক ভাবে মানা হয়েছে কি না। এ রকম আরও বেশ কিছু ক্ষেত্র থেকে, আমার মতে, বিচারবিভাগের দূরত্ব বজায় রাখাই ভাল।
একশো পঁচিশ কোটির দেশের মানুষ ইভিএম-এর সামনে দাঁড়িয়ে সরকারের নীতি এবং কর্মকাণ্ডের বিচার করেন। সেই বিচারের গুরুত্ব খাটো করে দেখার কোনও সুযুক্তি নেই।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিকাল সায়েন্সেস, কলকাতা’য় আইনবিদ্যার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy