সম্প্রতি প্রকাশনা সংস্থা টমসন রয়টার ফাউন্ডেশন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। নানা দেশের সাড়ে পাঁচশো জন মানবীবিদ্যার বিশেষজ্ঞের নিজের দেশে মহিলাদের সুরক্ষার অবস্থা নিয়ে মতামতের ভিত্তিতে তৈরি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, আফগানিস্তান, সিরিয়া বা পাকিস্তানের মতো দেশকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারত। ভারতই মেয়েদের জন্য সব চেয়ে অরক্ষিত, বলছে রিপোর্ট। যৌন নির্যাতনের সংখ্যা এবং অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিপ্রদানে সরকারের উদাসীনতা, এই দুইয়ের জন্য ভারতে মেয়েরা সর্বদাই ভয়ের আবহে বাস করেন।
রিপোর্ট বেরোতেই শোরগোল উঠেছে। কাঠুয়ার বালিকা বা দিল্লিতে নির্ভয়ার গণধর্ষণের মতো ঘটনার পর মিডিয়াতে যে ঝড় উঠেছে, তার ফলে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব স্বীকার করতে শিখেছে ভারতবাসী। তা বলে আফগানিস্তান-পাকিস্তান-সিরিয়ার চেয়েও খারাপ অবস্থা? শুরু হয় রাজনৈতিক চাপান-উতোর। বিরোধীরা দাবি করেন, এই সরকারের অপদার্থতাই দেশকে এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিচ্ছে! কেন্দ্রীয় সরকার প্রশ্ন তোলে, কিসের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট? কারা ওই বিশেষজ্ঞ? তাঁদের ‘পারসেপশন’-এর ভিত্তিতে এমন গুরুতর সিদ্ধান্ত কি আদৌ যুক্তিযুক্ত?
রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ভারত শিশুবিবাহ, যৌন শাস্তি ও কন্যাভ্রূণ হত্যায় এক নম্বরে। সরকারও স্বীকার করে, এক-তৃতীয়াংশ মেয়ের বিয়ে হয় আঠারো বছর বয়সের আগে। কন্যাভ্রূণ হত্যার জেরে অনেক রাজ্যে নারী-পুরুষের অনুপাত খুবই খারাপ। কিন্তু বাকি বিষয়গুলিতে এ হেন খারাপ ফলাফল যেন অবিশ্বাস্য।
এই রিপোর্ট আরও চমকে দেয় যখন দেখি নিরাপত্তার ঘাটতিতে তৃতীয় স্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র! যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ও সিরিয়া যথাক্রমে দ্বিতীয় ও যুগ্ম দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে প্রধানত স্বাস্থ্য পরিষেবায় মহিলাদের বঞ্চনার কারণে। যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধের আবহে মহিলাদের প্রথম যে পরিষেবা দিতে হয়, তা হল মানসিক আঘাত মোকাবিলার জন্য ‘ট্রমা কেয়ার।’ অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খারাপ ফলের মূল কারণ ধর্ষণ, বিশেষত স্বামী বা সঙ্গী দ্বারা। অতএব উন্নয়ন ও ধর্ষণের সম্পর্ক জটিল।
‘পারসেপশন’ বা ‘মনে হওয়া’ এড়াতে দেখা যাক পরিসংখ্যান। সংখ্যার হিসাবে সব চেয়ে বেশি ধর্ষণ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তার পর ব্রাজ়িল ও ভারত। তিনটিই জনবহুল দেশ। এক লক্ষ মানুষ প্রতি কত ধর্ষণ, সেই হিসেবে প্রথম ব্রিটেন, দ্বিতীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের স্থান সপ্তমে। ২০০৭ থেকে ২০১৬-র মধ্যে ভারতে ধর্ষণ বেড়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ, প্রতি ঘণ্টায় প্রায় চারটি করে এই অত্যাচার ঘটে এ দেশে। এই মাপকাঠিতে ১৫৩টি দেশের মধ্যে ১৩১ নম্বরে ভারত। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের চেয়ে খারাপ জায়গায় (উইমেন, পিস, সিকিয়োরিটি রিপোর্ট ২০১৭)।
এ দেশের ন্যাশনাল ক্রাইম বুরো-র তথ্য কী বলছে? প্রথমত, এটা ভুল যে ‘বিশেষ’ ধরনের লোলুপ পুরুষ ধর্ষণ করে ‘বিশেষ’ ধরনের চরিত্রহীন, স্বল্পবেশা মহিলাদের। এ দেশের ৯৫ শতাংশ ধর্ষক ধর্ষিতার পূর্বপরিচিত— বাড়ির ভিতরে বা বাইরে। দ্বিতীয়ত, লক্ষ-প্রতি ধর্ষণের নিরিখে দিল্লির স্থান পঞ্চম, পশ্চিমবঙ্গ দশম। অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এই ভয়ঙ্কর অত্যাচার কম করতে পারে না। কেরলের ধর্ষণ সংখ্যা (১২৫৬) তাই বিহারের (১০৪১) থেকে বেশি। আসলে এই সংখ্যাগুলি অপরাধের সংখ্যা নয়, অভিযোগের সংখ্যা। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণ বা ওই জাতীয় অপরাধে নির্যাতিতাকে দোষারোপ নতুন নয়। তাই ধর্ষিতার পরিবারকে গ্রামে একঘরে করা বা গণধর্ষণের ‘শাস্তি’ দেওয়ার খবর নিয়মিত শোনা যায়। পরিবারের মধ্যে বা পরিচিত কেউ অপরাধী হলে আইনি ব্যবস্থা এড়ানো হয়। সঙ্গে জাতিগত বা ধর্মগত বিদ্বেষ যোগ হলে অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। উল্টো চিত্রও দেখা যায়। সহমত হয়ে দু’জন বিবাহ বা সহবাস করলে, মেয়ের পরিবার অনেক সময়ে ছেলেটির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেন।
নির্যাতিত মেয়েটি আইনের সহায়তা পাবে কি না, তা অনেকাংশে নির্ভর করে তার সচেতনতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশের মানসিকতার উপর। উন্নত দেশে যে কোনও অপরাধ ঘটলেই আইনানুগ ব্যবস্থা করা হয়। তাই নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটলেও প্রতিকারের সম্ভাবনা বেশি। ধর্ষণ, নির্যাতনের অভিযোগের অন্তরালে থেকে যায় আরও নানা অপরাধ। শ্লীলতাহানি থেকে পাড়ার মোড়ে টিটকিরি। সুরক্ষার জন্য মেয়েরা কী কী করতে বাধ্য হন, সেটা আমরা খুব ভাবি না। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষক গিরিজা ব্রোকার দিল্লির চার হাজার ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছেন, তারা কলেজ নির্বাচন করছে শুধু শিক্ষার মান দেখে নয়, কলেজে পৌঁছনোর পথ কতটা সুরক্ষিত সেটা বুঝে। নিরাপদ রাস্তায় যাওয়ার তাগিদে তারা দিনে গড়ে চল্লিশ মিনিট বেশি সময় রাস্তায় থাকে। ছাত্রদের তুলনায় বছরে প্রায় ১৮,৮০০ টাকা বেশি ব্যয় করে।
আরও আছে। যেখানে রাতের শিফটে কাজ করতে হয়, সেখানে পারিশ্রমিক বেশি হলেও মহিলারা যোগ দিতে দ্বিধা করেন। শহরে এ ধরনের ক্ষেত্রে গাড়ি ও চালকের ব্যবস্থা হয়, নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু গ্রামের গরিব মেয়েরা বাড়ির বাইরে বার হতে খোঁজে পুরুষ অভিভাবকের হাত। সন্ধ্যায় টিউশনি পড়া বন্ধ হয়ে যায়, ভোরে বাইরে শৌচকর্মের জন্য যেতে হয় দল বেঁধে।
অর্থাৎ সুরক্ষার জন্য মহিলাদের সারা জীবন নানান মূল্য চোকাতে হয়। ‘অপরচুনিটি কস্ট’ অর্থাৎ সুযোগ পাওয়ার জন্য যা তাদের ত্যাগ করতে হয়, তা বড় কম নয়। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত সুরক্ষার পিছনে ছুটেও তারা অরক্ষিত। তাদের ঝুঁকি কত বিচিত্র, ঘরে-বাইরে আক্রমণ কত দিক থেকে আসে, তা পরিসংখ্যানে ধরা অসম্ভব। ধর্ষণ-নির্যাতন দিয়ে সুরক্ষার হিসেব করা চলে না। আপাত-নিরাপত্তার জন্য একটি মেয়েকে তার জীবনের অনেক ইচ্ছে, অনেক সুযোগ, আর তার মনের সৌকুমার্যকে বলি দিতে হয় বারংবার।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy