রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশন বসিলেই ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশ তাহার মঞ্চটিকে পরস্পরের প্রতি আক্রমণ শানাইবার জন্য ব্যবহার করিবে, ইহা যেন একটি বাৎসরিক প্রথায় দাঁড়াইয়া গিয়াছে। কিন্তু সেই প্রেক্ষিতেও গত কয়েক বৎসর ধরিয়া যত উচ্চগ্রামে ভারত সরকারের পাক-আক্রমণের তারটি বাঁধা হইতেছে, সে বিষয়ে কিছু মন্তব্য না করিলেই নয়। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জে যে ভাষায় কথা বলিলেন, তাহা কেবল ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের পক্ষে ক্ষতিকর নহে, ভারতের সম্মানের দিক হইতে দেখিলেও, ভুল পদক্ষেপ। প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে এই ভাবে সরাসরি তীব্র আক্রমণ করিলে, সন্ত্রাসবাদীরা মহানন্দে তাহার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে বলিয়া অভিযোগের তর্জনী তুলিলে বুঝিতে হয়, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানও যে কখনও কখনও সন্ত্রাসের নিশানা, সে বিষয়ে দৃকপাত করিতেও ভারত রাজি নহে। পাকিস্তানের নূতন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের তরফ হইতে প্রেরিত আলোচনার আমন্ত্রণ ভারত গ্রহণ করিবে কি না, তাহা দিল্লিরই বিবেচনা। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জে দাঁড়াইয়া যদি ভারতের মন্ত্রী বলেন যে আমন্ত্রণ আসিবার পরই জঙ্গি আক্রমণে ভারতীয় জওয়ানদের প্রাণহানির কারণে ভারত আলোচনায় সম্মতি রাতারাতি প্রত্যাহার করিল, তাহাতে নিজেদের ছেলেমানুষি সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হইয়া যায় না কি? কাশ্মীরে প্রাণহানির কারণে যদি গোসা করিতে হয়, তাহা হইলে তো প্রথমেই ইসলামাবাদের প্রস্তাবে দিল্লির রাজি হওয়া উচিত হয় নাই, কেননা কাশ্মীরে সন্ত্রাস-সংবাদ তো প্রায় প্রাত্যহিক বাস্তব। সুষমা স্বরাজ কিংবা তাঁহার প্রধানমন্ত্রী কি তাহা জানিতেন না? ইমরান খান সম্প্রতি বলিয়াছেন, ভারতে বড় বড় আসনে ছোট ছোট মানুষ আসীন হইয়াছেন। ভারতের মন্ত্রীদের শিশুসুলভ আচরণ দেখিলে সে কথায় বিষম আপত্তি তোলা মুশকিল হইয়া পড়ে।
কূটনীতি রাজনীতি নহে। সুষমা স্বরাজদের প্রথমেই মানিয়া লওয়া জরুরি যে তাঁহারা এমন একটি দেশের সহিত সমস্যায় জড়াইয়াছেন, যে দেশের রাজনীতি, সামরিক শক্তি এবং জঙ্গি কার্যক্রমের মধ্যে বহুধা সংযোগ সর্বজনস্বীকৃত বাস্তব। কোনও নেতা চেষ্টা করিলেও নিজেকে বা দেশটিকে সেই সংযোগ-জট হইতে দ্রুত মুক্ত করিয়া লইতে পারিবেন না। সুতরাং রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চ পাইলেই ক্রমাগত পাক নেতৃবর্গের দিকে অভিযোগের তির না ছুড়িয়া বরং সমস্যা সমাধানে নিজেদের ব্যগ্রতাটিকে প্রকাশ করাই কর্তব্য। কোনও কোনও প্রধানমন্ত্রী ইহা বুঝিয়া চলিয়াছেন। যেমন, অটলবিহারী বাজপেয়ী। পাকিস্তানি শীর্ষনেতাদের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে তাঁহার ধারণা ছিল, যদিও তিনি বর্তমান শাসক দলেরই নেতা ছিলেন। তাঁহার অনুসারীরা কোনও ভাবেই পাকিস্তানের বিষয়ে তাঁহার দূরদৃষ্টির উত্তরাধিকার পান নাই। তাঁহারা কেবল জট আরও জটিল করিয়া পাকাইতে শিখিয়াছেন।
তাই সুষমা স্বরাজ অন্যান্য দেশের সামনে পাকিস্তানকে বিশ্বাসঘাতক বলিয়া গাল পাড়েন। কংগ্রেস নেতা শশী তারুর সেই বক্তৃতাকে ‘হতাশাজনক’ বলিলে বিজেপি মুখপাত্ররা তাঁহাকে ‘পাকিস্তানের চর’ বলিয়া মুখরোচক রাজনীতির সুযোগ তৈরি করেন। অর্থাৎ তাঁহাদের কাছে পাকিস্তান বিষয়টি সর্বার্থেই ঘরোয়া রাজনীতিতে নম্বর তুলিবার সিঁড়ি, যাহার উপর ভর করিয়া, কংগ্রেস ও অন্য অবিজেপি-মতাবলম্বীদের পাকিস্তানের সমর্থক হিসেবে কলঙ্কলেপন করিয়া, নিজেদের ভোটারসমাজকে ভোটলড়াইয়ের অনুপ্রেরণা দেওয়া চলে। ভারতীয় নেতাদের এই সীমাবদ্ধতার সদ্ব্যবহার করিতেছে পাকিস্তান। কূটনীতির বদলে রাজনীতি করিবার সঙ্গত অভিযোগটি তুলিয়া আন্তর্জাতিক মঞ্চে বেশি নম্বর তুলিবার চেষ্টায় রত তাহারা। ভারত সরকারের জেদ ও আক্রমণপরায়ণতা ভারতের স্বার্থকেই বিপন্ন করিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy