একুশে ফেব্রুয়ারি সদ্য উদ্যাপিত হল। এই ঐতিহাসিক শুভক্ষণে সৈয়দ মুজতবা আলিকে না মনে করে পারি না। তিনি আমার চাচা, শুধুমাত্র সে কারণেই তো নয়। এমনকী সবাই তাঁকে যে কারণে জানে সে কারণেও নয়। তিনি মহৎ ঔপন্যাসিক, গল্পকার, ভাষাবিদ, রোম্যান্টিক, সুরসিক, স্যাটায়ার-সাহিত্যের অন্যতম প্রধান রচয়িতা— এ তথ্যও আজ আর কারও অজানা নয়। তাঁর প্রায় ত্রিশটি গ্রন্থ দু’বাংলাতে আজও তুমুল জনপ্রিয়। কিন্তু খুব কম মানুষই জানেন যে তিনি ভাষা আন্দোলনেরও এক জন প্রধান পুরোধা। কে-ই বা আজ আর মনে রেখেছেন যে সৈয়দ মুজতবা আলিই সেই ব্যক্তি, যিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রথম ডাক দিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে কিছু উর্দু চিন্তাবিদ ও অধ্যাপক এক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। যার মর্মার্থ ছিল ‘মুসলিম ভারত’-এর প্রধান ভাষা হোক উর্দু। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লিগের লখনউ অধিবেশনে তাঁদের মতবাদ খারিজ করে দিয়েছিলেন বাঙালি মুসলিম নেতারা। পরে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর উর্দু আন্দোলন আরও গতি পায়। তবে ভাষা আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার অনেক আগে, পাকিস্তান গঠিত হওয়ার মাত্র তিন মাস পরে ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদে একটি ঘটনা ঘটে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার ডাক দেন মুজতবা আলি। সে সময় সভায় উপস্থিত এক সংরক্ষণশীল অংশ তাঁকে অপমান করে। তাঁর যুক্তি খণ্ডন করার বহু চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আলি সাহেব টানা তিন ঘণ্টা তর্ক চালিয়ে যান। তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, যদি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর জোর করে উর্দু চাপানো হয় তবে এক দিন বিদ্রোহ হবে, যার জেরে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে।
সে দিন সিলেটের সেই বৈঠক থেকে হৃতমনোরথ মুজতবা আলি বেরিয়ে আসেন। প্রতিবাদের জেরে তাঁকে সিলেটও ছাড়তে হয়। কলকাতায় এসে তিনি তাঁর সে দিনের সেই বক্তৃতা প্রকাশ করেন ‘চতুরঙ্গ’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকায়। এখানেই শেষ নয়। বছরখানেক পর বোগরার একটি সাহিত্য সভায় সভাপতিত্বের ডাক পড়ে মুজতবা আলির। সেখানে তাঁর বাগ্মিতায় মুগ্ধ উপস্থিত অধ্যাপকরা আলি সাহেবকে স্থানীয় ‘আজিজুল হক কলেজে’র অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ করাতে চান। প্রথমে কলকাতার জমজমাট সাহিত্য পরিবেশ ছেড়ে তিনি আসতে চাননি, কিন্তু ছাত্র এবং শিক্ষকদের জোরাজুরিতে ১৯৪৯ সালে আলি সাহেব অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন ওই কলেজেই।
সেই সময়টাও ছিল অগ্নিগর্ভ। স্থানীয় ছাত্ররা ক্রমশই জড়িয়ে পড়েছে ভাষা আন্দোলনে। সংরক্ষণশীল অংশ মুজতবা আলির এই নিয়োগ ভাল চোখে দেখেনি। ষড়যন্ত্রও শুরু হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সে সময় কলেজ পত্রিকায় বেশ কিছু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার প্রতিপাদ্য ভাষা আন্দোলনকে রুখতে পুলিশের নির্যাতন। ঘটনা হল, এই নিবন্ধগুলি আলি সাহেব যোগ দেওয়ার অনেক আগেই নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক লেখা লিখতে ছাত্রদের প্ররোচিত করেছেন। পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রেফতারি এড়াতে, কলেজের মেয়াদ ৭ মাস হতে না হতেই মুজতবাকে ফিরে যেতে হয় কলকাতায়।
দেশজোড়া চাপের মুখে পড়ে পাক কর্তৃপক্ষ ১৯৫৬ সালে বাংলাকে অনেকগুলির মধ্যে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। একমাত্র তখনই মুজতবা তাঁর সিলেটের বক্তৃতাটি প্রকাশ করার সুযোগ পান। প্রথমে ‘আল ইসলাহ্’ পত্রিকায় এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা’ নামের একটি পুস্তিকায় এটি ছাপা হয়। অনেক পরে, ২০০২ সালে এই বক্তৃতা-নিবন্ধের পুনঃপ্রকাশ হয়।
যদিও জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই বিদেশে কাটিয়েছেন আমার চাচা, কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে প্রোথিত ছিল তাঁর শিকড়। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরেই তিনি ঢাকা চলে আসেন। আত্মীয়স্বজন, পরিবারের সঙ্গে জীবনের শেষ ক’টা দিন সেখানেই কাটান। ১৯৭৪ সালে ঢাকা শহরে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর লেখার অদম্য জাতীয়তাবাদের আবেগ আমাদের আজীবন পথ দেখাবে।
ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy