শিক্ষকদের উপর মারধর লাঠিচার্জ হইয়াছে? পুলিশ নির্মম ভাবে তাহাদের উপর চড়াও হইয়াছে? এ বারের শিক্ষক দিবসে শুনা গেল এই সকল অভিযোগ, এবং তাহাদের খণ্ডন যুক্তি। অভিযোগের কিয়দংশও সত্য হইলে তাহা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, দিনটি বিশেষ বলিয়া দুর্ভাগ্যের পরিমাণ আরওই বেশি। বাম সাংসদ মহম্মদ সেলিম আক্ষেপ করিয়াছেন, শিক্ষকদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রদ্ধাবোধের অভাব এই ঘটনায় স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী উত্তর দিয়াছেন যে, আর কোনও রাজনৈতিক কার্যক্রম যাঁহাদের নাই, তাঁহারাই এমন অকারণ অশান্তি তৈরি করেন। এহেন উত্তর-প্রত্যুত্তরের মধ্যে সাধারণ নাগরিকের মনে অবশ্য আর একটি ভাবনাও উদিত হয়। শিক্ষকদের সহিত পুলিশের সংঘাতের প্রশ্নটি আদৌ উঠিল এই কারণে যে, সে দিন শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানের আগে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আংশিক সময়ের শিক্ষকরা নিজেদের দাবি-দাওয়া লইয়া জমায়েত ও আন্দোলন শুরু করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সংগঠনের তরফে মিছিল আগাইতে শুরু করিলে পথ আটকাইয়াছিল পুলিশ। প্রশ্ন ইহাই যে, মিছিলের জন্য শিক্ষকরা ওই দিনটিকেই বাছিয়া লইলেন কেন? বাকি ৩৬৪ দিনই তো অধিকার দাবি বেতনহার ইত্যাদি লইয়া তাঁহারা যথেষ্ট ক্ষোভবিক্ষোভের মধ্যে বসবাস করেন, ওই একটি বিশেষ দিনকে কি বৎসরভর কর্মসূচি হইতে বাদ রাখা যাইত না?
প্রশ্নটি উঠাইবার দুইটি কারণ। প্রথমত অধিকার সংক্রান্ত দাবি এখন এই দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অপর নাম হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যে কোনও বিষয়েই সচেতনতার অর্থই কোনও না কোনও অধিকারের ভিত্তিতে দাবিদাওয়ার বন্যা বহানো। সচেতনতা বস্তুটির যে আরও অন্যান্য দিক থাকিতে পারে, শিক্ষকদের দায়দায়িত্ব বিষয়ে আলোচনা বা পরস্পরকে অবহিত করা, কিংবা ছাত্রছাত্রীদের সহিত একতা ও একাত্মতা দেখাইবার ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি এখন নেহাত অপ্রয়োজনীয়। অথচ গণতন্ত্র কিন্তু আবশ্যিক ভাবেই এমন হইবার কথা ছিল না। লাগাতার ক্ষোভের প্রদর্শনই রাজনীতির একমাত্র প্রকরণ হইবার কথা ছিল না। বছরের সব দিনই বাধ্যতামূলক ভাবে রাজনীতি করিতে হইবে, এমন কথাও ছিল না।
বিশেষত শিক্ষক দিবসের তো কিছু বিশেষ তাৎপর্য থাকিবারই প্রত্যাশা ছিল। পশ্চিমবঙ্গে আজও ওই দিনটিতে শিক্ষকসমাজের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের রেওয়াজ আছে। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনে শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে মর্যাদা দিবার আনুষ্ঠানিক আয়োজন আজও স্কুলে কলেজে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াইয়া আছে। ইহার পরিবর্তে শিক্ষক সমাজেরও কিছু দায় থাকিবার কথা, নিজেদের স্বার্থ অন্তত সাময়িক ভাবে ভুলিয়া বৃহত্তর সমাজের ভালমন্দ ভাবিবার কথা। অথচ এই সব অধিকার-আন্দোলনের কেন্দ্রে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত চাওয়া-পাওয়াই বিরাজ করিয়া থাকে। তবে কি সেই শিক্ষকসত্তা একেবারে বিলুপ্ত হইয়াছে যাহা এই সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে বিদ্যার সহিত সংবেদনকে যুক্ত করিতে চাহিত, সাফল্যের সঙ্গে সমমর্মিতাকে সমান গুরুত্ব দিত, এবং নিজেদের জীবনচর্যা দিয়া সেই দৃষ্টান্ত ছাত্রসমাজের সামনে তুলিয়া ধরিত? আশঙ্কা যেন ক্রমেই বাস্তব হইয়া উঠিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy