Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

সন্ত্রাসের উৎসই হোক বিনাশের আঁতুড়ঘর

ধর্মের নামে তাদের যা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে, তারা সব বিশ্বাস করেছে। কেউ তাদের শিখিয়েছে যে, অমুসলিমদের খুন করলে সর্বোচ্চ বেহেস্তে জায়গা হয়। মনে মনে ওরা বেহেস্তে গিয়েছে হয়তো। বাংলাদেশের জঙ্গিরা বিশ্ব কাঁপাতে চেয়েছিল, কাঁপিয়েছে। অমুসলমানদের খুন করে পুন্যি কামাতে চেয়েছিল, সম্ভবত তা-ও কামিয়েছে। এতগুলো মানুষকে অল্পবয়সি ছেলেগুলো কী করে পারল জবাই করতে! ওরা তো আগে কখনও জবাই করেনি। সত্যি কথা কী, বিশ্বাস মানুষকে দিয়ে অসম্ভব অসম্ভব কাজ করিয়ে নিতে পারে।

পরিণতি। লেবাননে সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীরা। জুন ২০১৬। রয়টার্স

পরিণতি। লেবাননে সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীরা। জুন ২০১৬। রয়টার্স

তসলিমা নাসরিন
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

বাংলাদেশের জঙ্গিরা বিশ্ব কাঁপাতে চেয়েছিল, কাঁপিয়েছে। অমুসলমানদের খুন করে পুন্যি কামাতে চেয়েছিল, সম্ভবত তা-ও কামিয়েছে। এতগুলো মানুষকে অল্পবয়সি ছেলেগুলো কী করে পারল জবাই করতে! ওরা তো আগে কখনও জবাই করেনি। সত্যি কথা কী, বিশ্বাস মানুষকে দিয়ে অসম্ভব অসম্ভব কাজ করিয়ে নিতে পারে। ওদের মগজধোলাই কে বা কারা করেছে আমি জানি না, তবে এটা জানি, যে তথ্যই ওদের মস্তিষ্কে ঢোকানো হয়েছে, কোনও প্রশ্ন ছাড়াই ওরা সেটা বিশ্বাস করেছে। ধর্ম সত্য, ধর্মগ্রন্থ সত্য, ধর্মগ্রন্থ স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা লিখেছেন, তাই যা কিছুই ওতে লেখা আছে, অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে হবে, কোনও প্রশ্ন নয়, শুধু মেনে নেওয়া। সুতরাং ধর্মগ্রন্থের শুরু থেকে শেষ অবধি সব কিছুকে ওরা নাক চোখ মুখ বুজে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করেছে। অ বলতে আসলে অ বোঝানো হয়নি, ভ বোঝানো হয়েছে— এই চালাকি

করে প্রাচীনকে যুগোপযোগী করার চেষ্টা করেনি। ‘অবিশ্বাসীদের মারো’ বললে ‘অবিশ্বাসীদের মারো’-ই বুঝেছে, অন্য কিছু বোঝেনি।

ধর্মান্ধ সমাজে মানুষের মগজধোলাই শুরু হয় জন্মের পর থেকেই। তখন থেকেই তারা ধর্মের গুণগান শোনে ঘরে বাইরে, ইস্কুলে কলেজে, মাঠে ঘাটে, ট্রেনে বাসে, টেলিভিশনে রেডিওয়, সিনেমায় নাটকে। শোনে ধর্ম মেনে চললে চমৎকার বেহেস্ত মেলে, না মানলে জ্বলতে হয় দোজখের বীভৎস আগুনে, ধর্মগ্রন্থে আছে দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান, ধর্মই জ্ঞান, ধর্মই বিজ্ঞান, ধর্মই শান্তি। সব সময় তুমি যদি কিছু শুনতে থাকো, ধরো মিথ্যে কিছুই, সেটিও অবচেতনে মগজে ঢুকে যায়। মাটিটা তৈরি হয়ে থাকে অল্প বয়সেই, তার ওপর বিশ্বাসের প্রাসাদ যে কোনও সময় খুব সহজেই বানিয়ে নেওয়া সম্ভব।

রাজনীতিকরা হিপোক্রিট। ধর্মের যেটুকু মানলে সুবিধে হয় শুধু সেটুকু মানব, বাকিটুকু মানব না— এই মানসিকতার মানুষগুলোও হিপোক্রিট। বরং ওই জঙ্গিগুলোই হিপোক্রিট ছিল না। ধর্মের নামে তাদের যা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে, সব বিশ্বাস করেছে। নিজের জীবনের মায়াটুকু করেনি, মরবে জেনেই এসেছিল সে-রাতে, বেহেস্তে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করেছে। কেউ তাদের শিখিয়েছে যে, অমুসলিমদের খুন করলে সর্বোচ্চ বেহেস্তে জায়গা হয়। অমুসলিমদের কুপিয়ে, হিজাব পরেনি বলে দুটো মুসলমান মেয়েকে কুপিয়ে, বর্বরতার চূড়ান্ত করে, সকাল হলে কিছু দিশি ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে, যারা কোরানের সুরা মুখস্ত বলতে পেরেছে, বলেছে, ‘আমরা এখানে শুধু অমুসলিমদের মারতে এসেছি। তোমাদের মারব না। তোমরা চলে যেতে পারো। আমরা তো বেহেস্তে যাচ্ছি’। মনে মনে ওরা বেহেস্তে গিয়েছে হয়তো। বাস্তবটা অন্য রকম। পুলিশের গুলি খেয়ে ওখানেই ওরা মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল। সন্ত্রাসের এখানেই কি যবনিকা পতন? মেরে সন্ত্রাস নির্মূল করা যায় না। সন্ত্রাসের উৎসকে নির্মূল করলেই সন্ত্রাস নির্মূল হয়।

মুক্তচিন্তা বারণ

আমার প্রশ্ন, সব ধর্মের সমালোচনা করা যায়, কেন ইসলামের সমালোচনা নৈব নৈব চ? কোনও কিছুকে কি সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখা উচিত? সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখলে কি শেষ পর্যন্ত আমাদের তরুণদেরই বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় না? তরুণরা যারা ইসলাম সম্পর্কে জানতে চায়, তারা এক মতের বাইরে ভিন্ন কোনও মত জানতে পারছে না। চার দিকের প্রচারযন্ত্র তাদের মাথায় দিনরাত এক বার্তাই ঢুকিয়ে দিচ্ছে যে, ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি অক্ষর সত্য, প্রতিটি মুসলমানকে তা মেনে চলতে হবে। মুক্তচিন্তার স্থান সেই জগতে নেই। যে সব ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের সমাজে মুক্তচিন্তার আবহাওয়া তৈরি করেছে, তারাই সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে। মুক্তচিন্তার চর্চা ছিল বলেই তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর অধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে ভেবেছে, এ সবকে ধর্মীয় আদেশ উপদেশের অনেক ওপরে স্থান দিয়েছে। তাদের আইনে, সংবিধানে ধর্মতন্ত্র নেই, আছে গণতন্ত্র। তারা কিন্তু ধর্মকে ছুড়ে ফেলেনি, ধর্ম মানার অধিকার তাদের পুরোটাই আছে। তবে ধর্ম বিশ্বাস করা ব্যক্তির কাজ, রাষ্ট্রের কাজ নয়— এটা শুরু থেকেই পরিষ্কার করে নিয়েছে ওরা। আমরা ওদের ভাল দিকগুলো নিচ্ছি না কেন? একটা সচেতন শিক্ষিত সমাজ গড়ে তুলছি না কেন? কেন ধর্মান্ধ বানাচ্ছি আমাদের ছেলেমেয়েদের! বিজ্ঞানও পড়ছে তারা, ধর্মেও ঝুঁকছে। বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মকে অনেকের কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। ধর্ম সব সমস্যার সোজা উত্তর দেয়, বিজ্ঞান কঠিন উত্তর দেয়। ধর্ম বুঝতে যত সহজ, বিজ্ঞান বুঝতে তত সহজ নয়। সেই কারণেই ধর্মকে বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি পছন্দ মানুষের।

মগজধোলাই করে ধার্মিক, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, মায় সন্ত্রাসী বানাবার লোক অনেক আছে, মগজধোলাই করে মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক বানাবার কিন্তু বেশি কেউ নেই।

বিজ্ঞানটা অধিকাংশ তরুণ পড়ছে ভাল চাকরিবাকরি পাওয়ার জন্য। বিজ্ঞানের বিগ ব্যাং বা বিবর্তন বিশ্বাস করার জন্য নয়। যে জিনিসে বিশ্বাস করার জন্য তাদের অভিভাবক বলছে, পাড়ার গুরুজন বলছে, স্কুলকলেজের শিক্ষক বলছে, ডাক্তার বলছে, বন্ধুবান্ধব বলছে, শুভাকাঙ্ক্ষী বলছে, সরকার বলছে, রেডিও টেলিভিশন বলছে, সে বিজ্ঞান নয়, সে ধর্ম। তাই তরুণরা ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছে। যে সন্ত্রাসীগুলোকে আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা সবাই ধার্মিক, তারা ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের কী করে দোষ দেব? তাদের কি আমরা মুক্তচিন্তার কোনও পরিবেশ দিয়েছি? প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্য আরও তরুণ তো ধর্মকর্ম করছে, কই তারা তো সন্ত্রাসী হচ্ছে না!

হচ্ছে না বাঁচোয়া। হওয়ার আশঙ্কা নেই, এ কথা কেউ হলফ করে আজ বলতে পারবে না। তারা হয়তো রিক্রুটারদের নজরে এখনও পড়েনি, হয়তো পড়বে। এক ক্লিক দূরত্বে এখন জঙ্গি হওয়ার আহ্বান, আইসিস-এর হাতছানি! এর মধ্যে দেশের দুশো ছেলের খবর নেই। আমাদের সাধারণ সংসার থেকে মেধাবী, প্রতিভাবান তরুণতরুণীরা হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কি সচেতন হওয়ার সময় এখনও আসেনি?

তাহমিদ সাফি এক জন শিক্ষিত যুবক, শিল্পী, শান্তিনিকেতনে গান শিখেছেন, গানও গাইতেন টেলিভিশনে, রবীন্দ্রসঙ্গীতে পিএইচ ডি করতে যাচ্ছেন—এমন সময় তিনি ধর্মে আকৃষ্ট হলেন, দেশ ছাড়লেন, এখন সিরিয়ায় আইসিস-এর ঘাঁটি থেকে ভিডিয়োতে জানিয়েছেন, গণতন্ত্র মানেন না, আল্লাহ্‌র আইন কায়েম করবেন, তা না হলে সবাইকে খুন করবেন, মরতে হলে মরবেন। এত ঠান্ডা মাথায় এই বুদ্ধিদীপ্ত যুবক কী করে পারেন মানুষ মারার কথা বলতে! মানুষ মারায় কোনও বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় নির্বুদ্ধিতার, বর্বরতার! বেহেস্তের লোভ এদের বুদ্ধি লোপ পাইয়ে দেয়! কী করে ঢাকা কাফের ওই অল্পবয়সি ছেলেগুলো একের পর এক মানুষকে জবাই করেছে! ধর্মে লেখা আছে বিধর্মীকে মারার কথা, সে কারণেই মেরেছে? ধর্মে তো আরও কত কথাই লেখা আছে! ‘ধর্মে কোনও জোরজবরদস্তি নেই’— কোরানের এই উপদেশটি কেন তারা গ্রহণ করে না? ছেলেদের কি এইটুকু বিচারবিবেচনা নেই— কী গ্রহণ করতে হয়, কী করতে হয় না?

কে বন্ধু, কে শত্রু

রাজনীতিকরা ধর্মীয় মৌলবাদীদের সঙ্গে আপস কেন করেন? কেন মসজিদ মাদ্রাসায় সন্ত্রাসের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে জেনেও তা রোধ করেন না, কেন ইস্কুল কলেজে এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মের পথ ধরে ছেলেমেয়েরা যে বদলে যাচ্ছে তা থামাতে চেষ্টা করেন না, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মকে যখন ব্যবহার করেন তখন এইটুকু দূরদর্শিতা কি তাঁদের থাকে না যে, এ ভাবে সমাজকে আরও তাঁরা হাজার বছর পিছিয়ে দিচ্ছেন? সন্ত্রাসীদের আস্তানা বাড়ছে, সন্ত্রাস বাড়ছে— সে কি আজ থেকে— এ সবের বিরুদ্ধে কই কোনও পদক্ষেপ তো নেওয়া হয় না? বরং ধর্মব্যবসায়ীদের সব সুযোগসুবিধে দান করার প্রতিযোগিতা চলছে যেন, সমাজের বা মানুষের কোনও মঙ্গল কি রাজনীতিকরা আদৌ চান? দেখে শুনে আমার তো মনে হয় না, তাঁরা দেশের কোনও ভাল চান।

মুসলমানদের তারা বন্ধু নয়, যারা মুসলমান সমাজকে সেখানেই রেখে দিতে চায়, যেখানে এবং যে ভাবে এটি আছে। অ-মুসলিম হলেই মুসলমানদের শত্রু তা ঠিক নয়। ইসলামের শত্রুরা ইসলামের কোনও সমালোচনা শুনতে চায় না। তারা বদ্ধ জলাশয়েই চায় পড়ে থাকুক ধর্মটি। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিত, আলোকিত, যুক্তিবাদী, বিবর্তনবাদী, অস্তিত্ববাদীদের মত প্রকাশের অধিকারে তারা বিশ্বাসী নয়। তারা মুসলমান সমাজের কোনও পরিবর্তন, বিবর্তন, কোনও বদল চায় না। প্রগতির পথে, সভ্যতা, সুস্থতা এবং সমানাধিকারের পথে সন্ত্রাসীরা যত না বাধা, তারও চেয়ে বড় বাধা এই ‘নরমপন্থী’ মুসলমানরা আর তাদের বন্ধুরা। এদের সংখ্যা সন্ত্রাসীদের চেয়ে বিপজ্জনক ভাবে বেশি। এদের কারণেই জন্ম হচ্ছে সন্ত্রাসীদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE