Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
কেউ শব্দ কোরো না, একমনে ‘লাইক’ করে যাও

দেবতার জন্ম

বিরোধীরা এর মোকাবিলায় শুধু যে নির্বাচনী জোট বাঁধতে এবং মোদীর বিকল্প একটি সর্বজনগ্রাহ্য মুখ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন তা-ই নয়, তাঁরা মোদীত্বকে ঘিরে একাগ্রতার এই বুনোটটিকেই উপলব্ধি করতে পারেননি।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৯ ০০:১৬
Share: Save:

নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, আপনারা যে যেখানে একটা করে ভোট দেবেন, জানবেন যে সেই ভোট মোদীর খাতায় জমা হচ্ছে। দেশবাসী মোদীর খাতা ভরিয়ে দিয়েছেন। ২০১৯-এর ভোট দেশবাসীর একাগ্রতার ভোট। মোদীর গত পাঁচ বছরের সবচেয়ে বড় সাফল্য এই একাগ্রতার নির্মাণ।

বিরোধীরা এর মোকাবিলায় শুধু যে নির্বাচনী জোট বাঁধতে এবং মোদীর বিকল্প একটি সর্বজনগ্রাহ্য মুখ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন তা-ই নয়, তাঁরা মোদীত্বকে ঘিরে একাগ্রতার এই বুনোটটিকেই উপলব্ধি করতে পারেননি। ২০১৪-র মোদী আর ২০১৯-এর মোদীর ভাবমূর্তির মধ্যে যে কতখানি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে, সেটা তাঁদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন, ২০১৪-তে মোদী নিজেকে যে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হিসেবে উপস্থাপিত করেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেই মানুষ মোদীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। যে কারণে অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ পড়েনি কেন, দু’কোটি চাকরি হয়নি কেন, এ সব প্রশ্ন বিরোধী প্রচারে বার বার উঠেছে। লাভ হয়নি। কারণ মোদী, অমিত শাহ এবং তাঁদের টিম এই পাঁচ বছরে একটা কাজ খুব মন দিয়ে করেছেন। তাঁরা ক্রমাগত মোদীকে ঘিরে একটা অতিমানবীয় সত্তা নির্মাণ করে গিয়েছেন। যেখানে সরকার, রাষ্ট্র, জাতি আর মোদী ক্রমশ সমার্থক এবং একীভূত বলে মনে হয়। মোদী শুধু মোদী নন, তিনিই যেন দেশ। তিনিই সেনাবাহিনী, তিনিই ডিআরডিও, তিনিই ইসরো, তিনিই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। মোদীকে পছন্দ না করা মানে তাই দেশকে ভাল না বাসা। মোদীর কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে দেশকে অসম্মান করা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালিত হয়েছে কি হয়নি, এই তর্কই যেন অবান্তর। মোদী তাঁর জনসভায় তাই স্বচ্ছন্দে বলতে পেরেছেন, রাস্তাঘাট-জল-বিদ্যুৎ নিয়ে কথা হবে কেন? এটা কি পুরসভা ভোট? এটা লোকসভা। এখানে দেশের সম্মান, দেশের নিরাপত্তা, আতঙ্কবাদ, সেনা অভিযান নিয়েই কথা হবে। মানুষ হাততালি দিয়ে জানিয়েছেন, ঠিকই তো! এটা তো ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ভাবার সময় নয়!

২০১৪ আর ২০১৯-এ মোদীর তফাত এটাই। প্রশাসক হিসেবে সাফল্য-ব্যর্থতার প্রশ্নটাকেই তুচ্ছ আর অবৈধ করে দিয়ে নিজেকে ভারতভাগ্যবিধাতা হিসেবে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করে ফেলা। মানুষের মনকে এই তারে বাঁধতে পারাটাই তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ। বালাকোট তার চূড়ান্ত সিলমোহর। পাকিস্তানকে সবক শেখানোর আনন্দে উদ্বেলিত জনতাকে বিরোধীরা বোঝাতে গিয়েছিলেন, এ সবই রোটি-কপড়া-মকানের সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর ছল। বালাকোটে আদৌ কতটা কী হয়েছে, কেউ জানে না। কিন্তু সে প্রশ্ন তুলতে চেয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা কাউকে প্রশ্নটা বোঝাতে পারেননি। প্রথমত, বিপক্ষের দামামার পাশে তাঁদের স্বর ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, যে ভাষায় তাঁরা কথাগুলো বলছিলেন, আজকের দুনিয়ায় তা অচল। ওহে আম আদমি, ওরা তোমাকে বোকা বানাচ্ছে— এ কথা বললে আজকাল আর কেউ তা ভাল মনে নেন না। বোকাই হই আর চালাকই হই, আমি আমার মতে চলব—স্মার্টফোন গণতন্ত্রের নাগরিক এই মন্ত্রে বিশ্বাসী। তুমি চাকরি পাওনি, সেইটে আগে ভাবো, পাকিস্তান নিয়ে ভেবে কী করবে— এই বয়ানের মধ্যে মানুষের প্রতি একটা অসম্মানও লুকিয়ে থাকে। লুকিয়ে থাকে একটা প্রচ্ছন্ন অধিকারভেদ। তার বদলে—আমি গরিবই হই, যা-ই হই, দেশমাতৃকার যজ্ঞে আমিও শামিল, মোদীজির সেনাদলে আমারও স্থান আছে— এই বোধ জনতাকে অনেক বেশি প্রাণিত করেছে, অন্তত এই মুহূর্তে।

নোটবন্দি, জিএসটি, রাফাল ইত্যাদি যে ভোটে প্রভাব ফেলল না, তার কারণও লুকিয়ে এখানেই। মোদীকে এমন ভাবে তুলে ধরা হল, যেন ঈশ্বরপ্রেরিত এক দূত নয়া ভারত গড়ার সাধনায় মন দিয়েছেন। তার জন্য সকলকে ধৈর্য ধরতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। পাঁচটা বছর তার পক্ষে কিছুই নয়। খুচখাচ অসুবিধা যা হবে, তার উপশমও একমাত্র মোদীই করতে পারেন। গোলযোগ না করে তোমরা শুধু তাঁকে এক মনে অনুসরণ করে যাও! বেকারত্বের রেকর্ড হার তাই মোদীকে বিপাকে ফেলেনি, বরং কর্মহীন যুবসমাজের একটা অংশকেই নিযুক্ত করা গিয়েছে কখনও গোরক্ষা বাহিনীতে, কখনও ভারতমাতা বাহিনীতে, কখনও জয় শ্রীরামে, কখনও ট্রোলে। তারাই গদা কাঁধে ঘুরেছে, হনুমান সেজে লাফিয়েছে, মোদীর নামে জয়ধ্বনি দিয়েছে।

মোদীত্বের এই নির্মাণটা সম্ভব হল কী করে? ৫৬ কোটি ইন্টারনেট উপভোক্তার দেশে পরিকল্পিত আর পরিশ্রমী প্রচারের ফলে। প্রথমে এক আঞ্চলিক নায়ক, ২০১৪-য় যাঁর সর্বভারতীয় অভিষেক হল। তার পর থেকে প্রতিটি দিন তিনি নিজের অতিকায়ত্বকে ‘আপডেট’ করে চললেন। নিজেকে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে রূপান্তরিত করলেন। মোদীই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, ৫৬ ইঞ্চি ছাতি যাঁর অভিজ্ঞান হল। মোদীই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যাঁর নামে অ্যাপ থেকে জিনিস বিক্রি হল। সত্য-উত্তর যুগের আগ্রাসী রাষ্ট্রনেতা এ দেশে কী রূপ পরিগ্রহ করতে পারেন, মোদী তার প্রমাণ। ২০১৪-য় তিনি দেখিয়েছিলেন, আইটি সেল-কে কী ভাবে ব্যবহার করতে হয় নির্বাচনী প্রচারে। ২০১৯-এও প্রচার-যুদ্ধে মোদীর ধারেকাছে কেউ নেই। পাঁচ বছর ধরেই নাগাড়ে বিজ্ঞাপন তাঁকে এক মুহূর্তের জন্য মানুষের মন থেকে সরতে দেয়নি। শৌচালয়, স্বচ্ছতা, বেটি বচাও, উজ্জ্বলা প্রকল্পের সাফল্য সরকারি দাবির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ না হতে পারে, কিন্তু ধারাবাহিক প্রচারের ফলে বিষয়গুলো জনপরিসরে পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে। সেই সঙ্গে পৌঁছেছে মোদীর মাহাত্ম্য।

বিগত পাঁচ বছরে মোদীর রাজনৈতিক জীবনটাই যেন সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালের মতো। ইন্টারনেট ডেটা পরিষেবার বাজারে বিপ্লব মোদী জমানাতেই ঘটেছে, তার পূর্ণ সুফলও মোদীই কুড়িয়েছেন। শুধু বাংলাতেই পঞ্চাশ হাজার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ সক্রিয় ছিল মোদীর প্রচারে। স্মার্টফোন-জনতার মনোযোগের মেয়াদ অতি স্বল্প। তাদের নজর ধরে রাখতে গেলে নিত্যনতুন খাদ্য দেওয়া চাই, নিত্যনতুন দৃশ্যের জন্ম দেওয়া চাই। মোদীর ক্যামেরা প্রীতি, তাঁর যোগাসন, তাঁর আলিঙ্গন, তাঁর মন কি বাত, তাঁর মাতৃভক্তি, তাঁর তপস্যা, তাঁর পা ধোয়ানো, তাঁর আমসেবন, তাঁর ফকিরি, তাঁর নবাবি— দেশের দৃশ্যপট জুড়ে শুধু তিনি। গাঁধীতেও তিনি, পটেলেও তিনি। সোশ্যাল মিডিয়া ইতিহাস ভালবাসে। সেখানকার অন্যতম জনপ্রিয় ট্রেন্ডই হল ‘জানেন কি’ সিরিজ়— দেখুন এই দুষ্প্রাপ্য ছবি, দেখুন এই বিরল ভিডিয়ো, জানেন কি অমুক বিস্মৃত চরিত্রের কথা...। সেই ‘ইতিহাস’সচেতন নাগরিকের জন্যই মোদী তাক থেকে পেড়ে আনেন কখনও নেহরু, কখনও নেতাজি, কখনও আইএনএস বিরাট!

এ নির্বাচনে ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা এবং খিল্লি ওড়ানোর যে প্রাবল্য দেখা যাবে, তা-ও তো জানাই ছিল। সামাজিক কথালাপের জায়গাটা আগেই গলাবাজি আর অসভ্যতার হাতে চলে গিয়েছিল। নির্বাচন শুধু দেখিয়ে দিল, ট্রোল আর মিমের ভাষাই আজ প্রচারের মূলধারার ভাষা। স্মার্টফোন গণতন্ত্র আপাতত বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা আর মেরুকরণের সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র। যে কোনও ললিত বাণীই সেখানে ব্যর্থ পরিহাস। ঘৃণাকে ভালবাসা দিয়ে জয় করবার ডাক যে ধুলো হয়ে উড়ে যাবে, এ আর আশ্চর্য কী। পুরনো নোটের মতো ভারতীয় রাজনীতির চেনা গতিপথটিও যে মোদীর হাতে বাতিল হয়ে গেল, সেটা বলাই যায়।

দুর্দশাগ্রস্ত কৃষক, নিপীড়িত দলিত আর বিপন্ন সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশও তাই এ বার মোদীকে ভোট দিলেন। দেওয়াল লিখনটা তাঁরা পড়তে পেরেছিলেন। মোদীই যে দেশের একমাত্র ভাগ্যনিয়ন্তা, এই ধারণাটাই তো পাঁচ বছর ধরে বোনা হয়েছে। তার ভিত্তিতেই সংখ্যাগুরুর ভোট একত্রিত হয়েছে। প্রান্তিকদের আর অন্য কিছু করারও ছিল না। এই পথেই হেঁটেছিল ২০০২-এর গুজরাত। ২০১৯-এর ভারত সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ করল। আপাতত এটাই নতুন ভারত। প্রশ্নহীন ভক্তি, বলদর্পী উল্লাস আর দমচাপা ভয়ের ভারত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Narendra Modi Internet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE