Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
ইংল্যান্ডের রানির কাছে সম্মান পেলেন ডাক্তার সত্য ভট্টাচার্য

ব্রিটিশ রানির বাঙালি ডাক্তার

পরের সোমবার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করলাম। বন্ধুরা তাঁকে ‘সত্য’ নামেই ডাকেন। মানুষটি বিনয়ী, লাজুক, নিজের সম্বন্ধে, নিজের কৃতি সম্পর্কে কিছু বলতে তাঁর স্বাভাবিক দ্বিধা, চিকিৎসক হিসেবে রাজপরিবারের নিজস্ব পরিসরের গোপনীয়তা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন।

ঐতিহাসিক: করিম কটেজ, যেখানে সপরিবার ছুটি কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে ডাক্তার ভট্টাচার্যের

ঐতিহাসিক: করিম কটেজ, যেখানে সপরিবার ছুটি কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে ডাক্তার ভট্টাচার্যের

শ্রাবণী বসু
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৮ ০১:১০
Share: Save:

লন্ডনে সে দিন রোদ ঝলমল করছে। নিজের বাড়িতে সপ্তাহান্তে জনা পঞ্চাশেক বন্ধুবান্ধবকে আপ্যায়ন করছেন ডাক্তার সত্যজিৎ ভট্টাচার্য এবং তাঁর স্ত্রী শান্তি, তিনিও চিকিৎসক। সেই সপ্তাহেই সুখবরটা এসেছে: ডাক্তার ভট্টাচার্য রয়াল ভিক্টোরিয়া অর্ডারে সম্মানিত হয়েছেন, রানির জন্মদিনের সম্মান তালিকায় লেফটেনান্ট অব দ্য ভিক্টোরিয়ান অর্ডার (এলভিও) হিসেবে স্থান পেয়েছে তাঁর নাম। তাঁর নিজের কথায় বললে, ‘‘সেই মুহূর্ত থেকে সবাই যেন একেবারে পাগল হয়ে গেল।’’ ফোন আর থামে না— ভারতে এবং ব্রিটেনে স্বজনবান্ধব সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত।

পরের সোমবার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করলাম। বন্ধুরা তাঁকে ‘সত্য’ নামেই ডাকেন। মানুষটি বিনয়ী, লাজুক, নিজের সম্বন্ধে, নিজের কৃতি সম্পর্কে কিছু বলতে তাঁর স্বাভাবিক দ্বিধা, চিকিৎসক হিসেবে রাজপরিবারের নিজস্ব পরিসরের গোপনীয়তা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন।

২০০৬ সালে ডাক্তার ভট্টাচার্য যখন প্রথম ভারতীয় হিসেবে রাজপরিবারের চিকিৎসক পদ অর্জন করেন, সেই সময় তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। দু’বছর আগের কথা। তিনি তখন সার্জেন্ট-সার্জন পদে উন্নীত হয়েছেন। তখন তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, তাঁরা স্কটল্যান্ডে রানির এস্টেট বালমোরাল-এ করিম কটেজ-এ বাস করেছেন। রানি ভিক্টোরিয়া তাঁর বিশ্বস্ত ভারতীয় সচিব আবদুল করিমের জন্য এই কটেজ তৈরি করান। আবদুল করিমের পরে সত্য ভট্টাচার্য সম্ভবত দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি রাজপরিবারে এতটা উচ্চপদ অর্জন করেছেন। ওই জায়গাটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য তিনি গভীর ভাবে উপলব্ধি করেন। ডাক্তারবাবু খুব ভাল ফটোগ্রাফার, আমাকে করিম কটেজের ছবি পাঠিয়েছিলেন, বালমোরাল এস্টেটে হরিণের ছবিও। তবে নিজের কোনও ছবি পাঠাননি।

পঞ্চাশটির বেশি চিকিৎসাবিজ্ঞানের পেপার প্রকাশ করেছেন ডাক্তার ভট্টাচার্য, চিকিৎসা সংক্রান্ত বইয়ের বহু অধ্যায় লিখেছেন, স্বক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্মানিত বোর্ড ও সোসাইটির সদস্য তিনি। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ট্যাটলার পত্রিকা তাঁকে ব্রিটেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা উপদেষ্টার স্বীকৃতি দিয়েছে। প্যাংক্রিয়াস সংক্রান্ত গবেষণার জন্য প্রচুর টাকা তুলেছেন তিনি।

স্ত্রী শান্তিকে নিয়ে তাঁর সুস্থির জীবন। শান্তির সঙ্গে তাঁর আলাপ মেডিক্যাল কলেজে, তাঁকে তিনি বলেন নিজের ‘বিরাট ভরসা’। বাংলা গান শুনতে ভালবাসেন, ভালবাসেন লো-ফ্যাট কেক আর পুডিং বেক করতে, এবং বেড়াতে। আলফনসো আমের পরম ভক্ত। পরিবেশ নিয়ে তিনি প্রবল ভাবে ভাবিত। মেয়ে কৃত্তিকার বয়েস এখন চব্বিশ। ম্যাঞ্চেস্টারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাশ করে এখন লন্ডনে রাজনৈতিক উপদেষ্টার কাজ করছেন। বাবা-মা থাকেন কলকাতায়।

সত্যবাবু বড় হয়েছেন মুম্বইয়ে। ওঁরা দুই ভাই, তিনিই বড়। বাবা দুর্গাপ্রসন্ন এবং মা কল্পনার বিরাট প্রভাব আছে তাঁর বড় হয়ে ওঠায়। বাবা তাঁকে বই, সঙ্গীত আর ফিল্ম ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন। মা তাঁর মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন ভাল, আরও ভাল করার তাগিদ। তাঁদের বাড়ি ছিল শিবাজি পার্কে— সেই শিবাজি পার্ক, যেখানে অনেক প্রসিদ্ধ ক্রিকেটার শৈশবে কৈশোরে হাত পাকিয়েছেন। পড়েছিলেন ডন বস্কো স্কুলে। রবি শাস্ত্রী সেই স্কুলের ছাত্র। তবে ডাক্তারবাবু অকপটে বলেন, খেলাধুলোয় তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল না। ডন বস্কো থেকে সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজ। বাংলা পড়তে এবং লিখতে শিখেছিলেন বাড়িতে। সে জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। তবে তাঁর আক্ষেপ, মেয়ের বেলায় সেটা করে উঠতে পারেননি।

ডাক্তার সত্য ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বললাম তাঁর মুম্বই থেকে লন্ডন যাত্রা নিয়ে, রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিয়ে, এবং তাঁর ব্যক্তিগত রুচি-পছন্দ নিয়ে।

প্রশ্ন: রানি সম্মানিত করলেন, কেমন লাগছে?

সত্যজিৎ ভট্টাচার্য: দারুণ। আমরা সবাই কাজের জন্য পরিশ্রম করি, কোনও পুরস্কার বা সম্মান পাওয়ার কথা ভাবি না। আমরা কেবল ভাবি, কাজটা কী করে ঠিকঠাক করা যাবে। তাই যখন এমন একটি অপ্রত্যাশিত সম্মান এসে হাজির হয়, তখন ভারী আনন্দ হয়। আর তা যদি আসে স্বয়ং রানির কাছ থেকে, তা হলে তো সেটা এক অস্বাভাবিক প্রাপ্তি!

তা ছাড়া, এই সম্মান পাওয়ার গোটা ব্যাপারটা আমাকে খুবই বিনত করেছে। বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, পরিবারের কাছ থেকে এত শুভেচ্ছাবার্তা পেয়েছি, আমি সত্যই কৃতজ্ঞ। যাঁরা আমার শিক্ষক, আমাকে যাঁরা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যাঁরা আমাকে কর্মজীবনে সাহায্য করেছেন, এই পুরস্কার আমাকে তাঁদের সকলের কথা স্মরণ করিয়েছে।

প্র: সার্জেন্ট-সার্জন হিসেবে আপনার কাজ কী?

উ: সার্জেন্ট-সার্জন হলেন সেই সিনিয়র সার্জন, যাঁর হাতে রাজপরিবারকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব। এটা সামরিক পদ নয়। অতীতে সার্জন রাজার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রেও যেতেন, তাই এমন নাম।

রাজপরিবারের যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়, তবে আমার ডাক পড়বে। আমার বিশেষ প্রশিক্ষণ উদরের অসুখের চিকিৎসায়— লিভার, গল ব্লাডার এবং প্যাংক্রিয়াসের অস্ত্রোপচারে। শরীরের অন্য অঙ্গে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হলে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেটা ঠিক করাও আমার কাজ। তবে আমি এখনও রয়াল লন্ডন এবং সেন্ট বার্থলমিয়ু’জ় হাসপাতালেও সার্জন হিসেবে কাজ করি। আর বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র লন্ডন ক্লিনিক-এর মেডিক্যাল ডিরেক্টরের পদেও রয়েছি।

রাজবাড়িতে ডাক পড়ে মাঝে মধ্যে। সাধারণত, রোগী কোনও হাসপাতালে বা চেম্বারে আমার কাছে আসেন, অবশ্যই প্রাইভেসির উপযুক্ত বন্দোবস্ত থাকে। রাজবাড়ি মানে কেবল বাকিংহাম প্যালেস নয়, স্যানড্রিংগ্যাম বা উইন্ডসর প্যালেসও হতে পারে। এবং কেবল রাজপরিবারের নয়, সংশ্লিষ্ট অনেকের, এবং রাজপ্রাসাদের কর্মীদের চিকিৎসার দায়িত্বও আমার।

প্র: রাজপরিবারের চিকিৎসক হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?

উ: এক জন ডাক্তার প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে তাঁর চিকিৎসার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেন, সেই রোগী সমাজের যে স্তর থেকেই আসুন না কেন। সে দিক থেকে দেখলে এক জন চিকিৎসক হিসেবে আমার নিয়মিত কাজের থেকে এই কাজ আলাদা কিছু নয়। কিন্তু রাজপরিবারের চিকিৎসায় গোপনীয়তা রক্ষার একটা বিশেষ দায়িত্ব থাকে। রাজবাড়ি থেকে ডাক যে খুব ঘন ঘন আসে তা নয়, কিন্তু যে কোনও সময় ডাকলেই যেন আমায় পাওয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হয়। দেশের বাইরে থাকলে কোনও সহকর্মীকে কাজ সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে যেতে হয়।

প্র: লন্ডন এসেছিলেন পড়তে, তার পর ফিরে গেলেন মুম্বই, আবার লন্ডনে ফিরে এলেন কেন?

উ: আমি ডাক্তারি পড়েছিলাম মুম্বইয়ের সব চেয়ে পুরনো মেডিক্যাল কলেজ, গ্রান্ট মেডিক্যাল কলেজ (জে জে হসপিটাল)-এ। ১৯৮৪ সালে পাশ করি। কলেজের ফাইনাল ইয়ার থেকেই আমার কাছে এটা পরিষ্কার ছিল যে, সার্জন হতে চাই। জেনারেল সার্জারিতে এমএস করার পর লন্ডনে আসি ১৯৮৮ সালে, আরও প্রশিক্ষণ নেব, এফআরসিএস করব, জগৎটাকে দেখব বলে। লন্ডনে রয়াল ফ্রি হসপিটাল-এ লিভার সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নিই। তার সঙ্গে একটি গবেষণা করি এবং গবেষণাপত্র জমা দিই। তার পর, ছ’বছর বাদে, আমার প্রাথমিক পরিকল্পনা মাফিক ভারতে ফিরে যাই।

কিন্তু ভারতে যে সরকারি হাসপাতালগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করি, তাদের বেশির ভাগই আমার পরামর্শ নেওয়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিল না। তখন দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে যোগ দিই। কিন্তু সেই কাজটাতেও আমার মন ভরছিল না। আমি স্রেফ এক জন জেনারেল সার্জন হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছিলাম, লন্ডনে লিভার সার্জারিতে যে বিশেষ ট্রেনিং নিয়েছিলাম তা প্রয়োগ করতে পারছিলাম না। তা ছাড়া সরকারি ব্যবস্থায় যে মানসিকতা থাকে, গবেষণা আর পড়ানোর যে সুযোগ থাকে, ওখানে সেটাও ছিল না। আমার স্ত্রীর অনুভূতিও ছিল একই রকম। প্রসঙ্গত, আমার স্ত্রী শান্তি ডায়াবিটিস ও এন্ডোক্রিনোলজি বিষয়ক ডাক্তার। ও আমার খুব বড় বল-ভরসা। আমরা দু’জন দু’জনকে পরামর্শ করে সব কাজ করি। তাই এক বছর বাদে যখন লন্ডনের হাসপাতাল থেকে কাজ করার ডাক পেলাম, তখন ফিরে এলাম। কাজের দিক থেকে দেখলে, আমরা কোনও দিন এ নিয়ে আক্ষেপ করিনি।

রয়াল লন্ডন এবং সেন্ট বার্টস-এ কাজের সূত্রে ওখানে আমি লিভার ও প্যাংক্রিয়াস সার্জারির একটি ইউনিট খুলেছি, যা আগে ছিলই না। আমি ছাত্রদের পড়াই, সার্জনদের ট্রেনিং দিই, গবেষণা প্রবন্ধ লিখি। আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ ক্ষণ আসে, যখন আমায় শল্যচিকিৎসার পাঠ্যবইয়ের একটি অধ্যায় লিখতে অনুরোধ করা হল, যে বই কিনা মেডিক্যাল কলেজে আমাদেরও পড়তে হত।

প্র: অবকাশে কী করেন?

উ: আমি খুব বই পড়ি। এখনকার লেখকদের মধ্যে মেডিসিন বিষয়ে অতুল গাওয়ান্ডে-র লেখা, এলিজ়াবেথ স্টাউট-এর উপন্যাস, ১৯২০-র কলকাতার পটভূমিকায় আবির মুখোপাধ্যায়ের ক্রাইম-উপন্যাস ভাল লেগেছে। বাংলায় বুদ্ধদেব গুহ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা বিশেষ ভাল লাগে। গান শুনতেও ভালবাসি। বাংলা গানও শুনি। আমার প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে আছেন শ্রীকান্ত আচার্য, জয়তী চক্রবর্তী। দোহারের গানও পছন্দ করি।

নিয়মিত যোগাসন করি। বাড়ির সবাই মিলে বেড়াতে ভালবাসি। সম্প্রতি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ভালুক এবং তিমি দেখার অভিজ্ঞতাটা সেরা। খেলার মধ্যে ভারত আর ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের খবর রাখি। আর, ফুটবলে আর্সেনাল— আমার পাড়া, সেই উত্তর লন্ডনের ক্লাব তো!

আর একটা কথা। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি আর বন্যপ্রাণীর বাসভূমি নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমস্যা আমাকে গভীর ভাবে ভাবায়, এটা আমার প্রতিনিয়ত উদ্বেগের বিষয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Doctor London
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE