Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Editorial News

অভিমুখটা সরে যাচ্ছিল, সতর্কবার্তা দিলেন জনতা জনার্দন

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দরজায় যখন আবার করাঘাত করতে শুরু করেছে সাধারণ নির্বাচন, ঠিক সেই সময়ে এই বার্তা আসলে দেশের প্রধান শাসকের প্রতি একটা সতর্কবার্তাও।

দীর্ঘ দিন পর নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের নেতৃত্বাধীন বিজেপি কোনও বড় ধাক্কা খেল নির্বাচনে। ছবি: সংগৃহীত।

দীর্ঘ দিন পর নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের নেতৃত্বাধীন বিজেপি কোনও বড় ধাক্কা খেল নির্বাচনে। ছবি: সংগৃহীত।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৫৬
Share: Save:

জনগণতন্ত্রে জনতাই যে জনার্দন, সে কথা আরও এক বার মনে করিয়ে দিল পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। ফল প্রকাশিত হতেই জনগণের কণ্ঠস্বর যেন ফের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হিসাবে ধরা দিল। কংগ্রেস নয়, বিজেপি নয়, অন্য কোনও পক্ষ নয়— জনকণ্ঠের প্রতিফলন ঘটল যেন এই ভোটযুদ্ধের ফলাফলে। ভারতের আম জনতা আরও এক বার মনে করিয়ে দিল, গণতান্ত্রিক পরিসরে জনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

দীর্ঘ দিন পর নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের নেতৃত্বাধীন বিজেপি কোনও বড় ধাক্কা খেল নির্বাচনে। বস্তুত মোদী-শাহ জুটির হাতে বিজেপির রাশ যাওয়ার পর থেকে এটাই বিজেপির জন্য সবচেয়ে বড় নির্বাচনী ধাক্কা। বিজেপি নির্বাচনে ধাক্কা খেলেই জনগণের কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয় আর বিজেপি জিতলেই জনকণ্ঠ অবহেলিত থেকে যায়, এমন নয় নিশ্চয়ই। এ দেশে বিজেপির প্রতিটি জয়ও নাগরিকের সমর্থনের ভিত্তিতেই এসেছে। কিন্তু একের পর এক বিপুল জয়ের উপরে দাঁড়িয়ে কোনও দল যখন প্রবল প্রতাপশালী হয়ে ওঠে, তখন লড়াইটা কোথাও যেন শাসকের দাপট আর বিরোধীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, জনতা জনার্দন যেন ঈষৎ গৌণ হয়ে পড়েন। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা এবং মিজোরামের ভোটে সেই জনতা জনার্দনই অনেক দিন পর যেন নিজের গুরুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন।

২০১৪ সালে ঐতিহাসিক বিজয় পেয়েছিল বিজেপি। ভারতের ইতিহাসে প্রথম বার বিজেপি একাই লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। দেশের জনতাই বিজেপিকে সেই বিপুল বিজয় উপহার দিয়েছিল, এই নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু পরবর্তী সাড়ে চার বছরে বিজেপির সেই ঐতিহাসিক বিজয়ই আরও দৃঢ়মূল হওয়ার চেষ্টা করেছে ভারত জুড়ে, একের পর এক রাজ্যে ঝড় তুলে ক্ষমতা দখল করেছে বিজেপি, রাজ্যসভার ইতিহাসে প্রথম বার কংগ্রেস বৃহত্তম দলের তকমা হারিয়েছে। বিজেপির এই মহাবিক্রম জয়যাত্রা কোনও অবৈধ পথে কিন্তু আসেনি। বৈধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই একের পর এক সাংবিধানিক পদ বিজেপির হস্তগত হতে থেকেছে। আর সেই প্রক্রিয়াটা চলাকালীনই অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে আলোকবৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু থেকে জনতা জনার্দন বেশ খানিকটা যেন দূরে সরে গিয়েছেন। কৃষক কী চাইছেন, মধ্যবিত্ত চাকুরের সমস্যাটা ঠিক কোথায় বাড়ছে, ব্যবসায়ীর সঙ্কট কী ভাবে ঘনিয়ে উঠছে, কর্মসংস্থানের আশায় ঘুরতে থাকা যুবা কী চাইছেন— এ সব যেন ক্রমশ গৌণ হতে থেকেছে। বিজেপির রাজনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখা, গণতান্ত্রিক ভারতের কাঠামোয় বিজেপির শিকড় আরও গভীরে পৌঁছে দেওয়া, বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ এবং ক্রমবর্ধমান রাখা— ভারতের শাসক দলের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল যেন এই সবই। পাঁচ রাজ্যের এই বিধানসভা নির্বাচন অতএব বিজেপির জন্য সম্বিৎ ফেরানোর একটা নির্বাচন।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

গণতন্ত্রে শাসক প্রতাপশালী হতে পারবেন না, এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু কোনও একটি দল অখণ্ড প্রতাপে শাসন চালাতে শুরু করলে রাজনীতিটাকে একতরফা দেখায়। বিরোধীরা অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছেন, দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকের মুখোমুখি দাঁড়াতেই পারছে না কোনও বিরোধী দল— এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে গণতন্ত্রটা যেন একটু একপেশে হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক লড়াইয়ের কেন্দ্রে তখন আর জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বিরাজ করে না। শাসক নিজের প্রতাপ বহাল রাখতে পারছেন কি না, বিরোধী নিজের পায়ের তলার জমি ধরে রাখতে পারছেন কি না— নির্বাচন তখন এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর দাঁড়িয়ে হয়। বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়াটার অনর্গল জয়যাত্রা নির্বাচনগুলোকে অনেকটা সেই রকম অভিমুখেই নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রে জনতাই জনার্দন। অতএব পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে রাজনীতির অভিমুখটাকে আবার ঘুরিয়ে দিল জনতাই।

দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে কৃষক অসন্তোষের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ছিল না, কর্মসংস্থান সংক্রান্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালিত হয়নি, আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় মুদ্রার দাম কমছিল, নোটবন্দির জেরে ভারতীয় অর্থনীতির ধাক্কা খাওয়ার আখ্যান নিয়ে চর্চা বাড়ছিল। অসন্তোষ শুধু সাধারণ নাগরিকের মধ্যে বাড়ছিল না, অসন্তোষের আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছিল ক্ষমতার উচ্চ অলিন্দগুলোতেও। একটা সরকারের মেয়াদে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দু’জন গভর্নরের পদত্যাগ, সুপ্রিম কোর্টের কার্যপ্রণালী নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তুলে চার বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলন, সিবিআইয়ের শীর্ষ স্তরে বেনজির টানাপড়েন— এ সব তো চলছিলই। দেশের প্রধান শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে দূরে সরতে শুরু করে দিয়েছিলেন একের পর এক শরিক। কিন্তু রাজনৈতিক বিতর্কের বৃত্তে এই সব চর্চাকে ঠাঁই দিতে দেশের শাসক দল খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছিল না যেন। হিন্দুত্ব, গোরক্ষা, মন্দির-মসজিদ, নামবদল— রাজনৈতিক চর্চায় এগুলোকেই যেন প্রাধান্য দিতে চাইছিলেন শাসক।

আরও পড়ুন: থেমে গেল নরেন্দ্র মোদীর বিজয়রথ! সেমিফাইনালে ধাক্কা মোদীত্বে

শাসকের রাজনীতির এই অভিমুখটা যে জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা সুবিধা-অসুবিধা কেন্দ্রিক নয়, তা বলাই বাহুল্য। জনসাধারণের সমর্থনের ভিত্তিতেই রাজনৈতিক দাপট অব্যাহত রাখার চেষ্টায় ছিল বিজেপি। কিন্তু জনসাধারণের কণ্ঠস্বরকে বিজেপির কণ্ঠস্বর করে তোলার চেষ্টা অন্তর্হিত হচ্ছিল, বিজেপির কথাকে জনসাধারণের কথায় পরিণত করার একটা প্রয়াসও লক্ষ্য করা যাচ্ছিল যেন। অতএব জনতা জনার্দনের দরবার থেকে একটা বিপ্রতীপ বার্তা আসা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সেই বার্তাটাই এল পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দরজায় যখন আবার করাঘাত করতে শুরু করেছে সাধারণ নির্বাচন, ঠিক সেই সময়ে এই বার্তা আসলে দেশের প্রধান শাসকের প্রতি একটা সতর্কবার্তাও। অতএব লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার রাজনৈতিক সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে হাজির জনসাধারণের দৈনন্দিন টানাপড়েন। ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্যটা এখানেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE