Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

প্রতীক

দলিত বলিয়াই তাঁহাদের ঠাঁই হয় সমাজের তলায়। সেই দলিত, যে পরিচয়ের রাজনীতি রাষ্ট্রপতি পদে রামনাথ কোবিন্দকে শাসক বিজেপির প্রার্থী করিয়াছে।

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ম্যানহোলের উন্মুক্ত মুখের ফাঁক গলিয়া যেটুকু আলো নীচের পূতিগন্ধময় অন্ধকারে পৌঁছাইয়াছে, তাহাতে দৃশ্যমান, এক জন মানুষ আবক্ষ জলে দাঁড়াইয়া আছেন।— মঙ্গলবার এই পত্রিকার কলকাতা বিভাগে যাঁহার ছবিটি প্রকাশিত হইয়াছে, মহানগরের নিকাশি সাফাইয়ের কাজে নিযুক্ত সেই মানুষটির পরিচয় অজ্ঞাত। কিন্তু, অনুমান করা চলে, তিনি দলিত। কারণ, যাঁহারা— ‘টিনের তলোয়ার’ স্মরণীয়— ‘কলকাতার তলায়’ থাকেন, তাঁহারা প্রত্যেকেই দলিত। দলিত বলিয়াই তাঁহাদের ঠাঁই হয় সমাজের তলায়। সেই দলিত, যে পরিচয়ের রাজনীতি রাষ্ট্রপতি পদে রামনাথ কোবিন্দকে শাসক বিজেপির প্রার্থী করিয়াছে। ম্যানহোলের অন্ধকারে থাকা মানুষটি সম্ভবত কোবিন্দের নাম শোনেন নাই। রামনাথ কোবিন্দ অদূর ভবিষ্যতে পটনার রাজভবন হইতে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছাইলেও এই মানুষটির ম্যানহোল হইতে পরিত্রাণ নাই। যেমন নিস্তার নাই দিল্লির বাল্মীকি কলোনির বাসিন্দাদের, গুজরাতের উনায় মৃত গরুর চামড়া ছাড়াইবার অপরাধে প্রহৃত মানুষদের, উত্তরপ্রদেশ-মধ্যপ্রদেশে ধর্ষিতাদের, হায়দরাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে রোহিত ভেমুলার। যে জাতি মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে ‘জনক’-এর স্বীকৃতি দেয়, যে দেশের সংবিধান রচিত হইয়াছিল ভীমরাও রামজি অম্বেডকরের তত্ত্বাবধানে, সেই দেশে ‘দলিত’ পরিচিতি আজও প্রাত্যহিক অবমাননা, গ্লানির সমার্থক। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া সরকারি দফতরই দলিত ‘ক্যাজুয়াল’ শ্রমিককে ম্যানহোলে নামাইয়া দেয়। শত আইন, সহস্র বার উচ্চারিত সদিচ্ছা, এমনকী রাজননৈতিক ক্ষমতাও দলিতদের সমমানুষের মর্যাদা আনিয়া দিতে পারে নাই। যে উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী ক্ষমতাচ্যুত হইলেও তাঁহার মূর্তিগুলি বিদ্যমান, সেই রাজ্যই দলিত-নিগ্রহে দেশে প্রথম সারিতে। অতএব, সত্য সে যে অতি সুকঠিন, রামনাথ কোবিন্দের ‘দলিত’ পরিচিতিতে ভারতের দলিতদের নয়া পয়সারও লাভ নাই।

রাজনীতির স্রোত ‘দলিত’ পরিচিতিটিকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করিয়া লয়। রামনাথ কোবিন্দও সম্ভবত ব্যতিক্রম নহেন। নরেন্দ্র মোদীর শাসনকাল দেশের দলিতদের পক্ষে সুখকর হয় নাই। রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা বা উনায় দলিত নিগ্রহ উদাহরণমাত্র— বিজেপির হিন্দুত্ববাদে মুসলমানরা যতখানি বিপন্ন হইয়াছেন, দলিতদের বিপন্নতা তাহার তুলনায় খুব কম নহে। রাষ্ট্রপতি পদে কোনও দলিতকে প্রার্থী করিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, ফলত সর্বসম্মতি, অর্জন করা সহজ হইবে, ইহাই সম্ভবত একমাত্র হিসাব নহে— হিন্দুত্ববাদের স্লোগানে যাঁহাদের ধরা যায় নাই, ২০১৯ সালের নির্বাচনে সেই দলিতদের ভোট টানিবার স্বার্থচিন্তাটিও বিলক্ষণ আছে। অতএব, রামনাথ কোবিন্দকে তাঁহার ‘দলিত’ পরিচিতিতে নহে, রাজনৈতিক পরিচিতিতে দেখাই বিধেয়। কারণ, ‘দলিত’ পরিচিতিটি রাজনীতির অংশমাত্র, তাহার অধিক কিছু নহে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলিয়াছেন, ভারতে কি আর কোনও দলিত নেতা নাই? তিনি নিজেও নিশ্চয়ই জানেন, প্রশ্নটি অবান্তর, কারণ কে রাষ্ট্রপতি হইবেন, তাহা শাসকদলের মর্জিতেই নির্ধারিত হয়। বরং, প্রশ্ন করা চলে, যাঁহার রাজনৈতিক পরিচিতির কার্যত সম্পূর্ণ অংশ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ন্যায় হিন্দুত্ববাদী প্রতিষ্ঠানের সহিত জড়িত, সাংবিধানিক ভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশের সাংবিধানিক প্রধান পদে তাঁহাকে প্রতিষ্ঠা করা কি প্রজাতন্ত্রের পক্ষ সুসংবাদ? বিশেষত, যখন অসহিষ্ণুতাই ভারতের বৃহত্তম সমস্যা হইয়া উঠিয়াছে? এ যাবৎ প্রত্যেক শাসকই রাষ্ট্রপতি পদে নিজেদের পছন্দসই প্রার্থীকে বসাইয়াছে বটে, কিন্তু তাঁহাদের রাজনৈতিক পরিচিতির সহিত দেশের সাংবিধানিক চরিত্রের এমন প্রত্যক্ষ সংঘাত ছিল না। এখানেই কোবিন্দ পৃথক, বিজেপির শাসনও পৃথক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE