মেয়ে দেবস্মিতাকে নিয়ে একটি মণ্ডপে মৌমিতা। নিজস্ব চিত্র
হুইলচেয়ারে আসীন কন্যাকে কলিকাতার পূজা দেখাইতে চাহিয়াছিল একটি পরিবার। বহু পূজা মণ্ডপে তাঁহারা ঢুকিতে পারেন নাই, কারণ হুইলচেয়ার ঢুকিবার ব্যবস্থা সেখানে নাই। কয়েকটি মণ্ডপে উদ্যোক্তারা উদ্যোগী হইয়া হুইলচেয়ারটি বহিয়া প্রবেশের ব্যবস্থা করিয়াছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাহা ঘটে নাই। অর্থাৎ শিল্পের উৎকর্ষ ও অভিনবত্ব লইয়া পূজা উদ্যোক্তারা যতটা চিন্তিত, এই মানবিক দিকটি লইয়া অতটা নহেন। অথচ প্রতিবন্ধীরা এই সমাজেরই অংশ। তদুপরি, বার্ধক্য ও অসুস্থতার কারণে অনেকেই চলাফেরার স্বাচ্ছন্দ্য হারাইয়াছেন। তাঁহারা যাহাতে নির্বিঘ্নে পূজা দেখিতে পারেন, তাহার কী ব্যবস্থা করা হয়? বহু দূর হইতে তাঁহাদের হাঁটিতে হয়। অনেকে বিশ্রামের জন্য একটু বসিবার জায়গাও পান না, ক্লাবের কর্মকর্তা বা স্থানীয় মানুষ সব চেয়ার দখল করিয়া বসিয়া থাকেন। প্রতিবন্ধী বা অশক্তদের আলাদা প্রবেশের সুবিধা নাই। পূজার ব্যবস্থাপকদের এই উদাসীনতা বস্তুত সার্বিক উদাসীনতারই প্রতিফলন। সংবৎসর যে মানুষগুলি উপেক্ষিত, পূজার ভিড়ের উন্মাদনায় তাঁহাদের কে মনে রাখিবে? জনগণনা অনুসারে ভারতে দুই কোটিরও অধিক মানুষ প্রতিবন্ধী। অসুস্থতা ও দুর্ঘটনার জন্য আরও অনেক মানুষ প্রতিবন্ধকতার শিকার। কিন্তু জনজীবনে তাঁহারা কার্যত ব্রাত্য। ফলে ‘সর্বজনীন’ পূজাতেও তাঁহারা বাদ পড়িতে বাধ্য।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যে সকল শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতা অনুভব করেন, যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং সহায়তায় সেগুলির মোকাবিলা করিতে তাঁহাদের অধিকাংশই সক্ষম। সেগুলি বড় বাধা হইয়া দাঁড়ায় না। সমস্যা বস্তুত অপরাপর ‘অপ্রতিবন্ধী’ মানুষ, যাঁহারা অন্যের মধ্যে প্রতিবন্ধকতার আভাস পাইলেও তাঁহাকে ‘ভিন্ন’ প্রতিপন্ন করিয়া দূরে সরাইয়া রাখিতে চান। প্রতিবন্ধীদের এমন আলাদা করিয়া আড়াল করিবার মানসিকতা অত্যন্ত দুঃখজনক। ইহার দৃষ্টান্ত অগণিত। রাজপথে সুদৃশ্য ধাতব রেলিং বসাইতে যদি টাকা বরাদ্দ করা যাইতে পারে, তবে তাহার দুই দিক ঢালু করিয়া গড়িতে কী এমন ব্যয় হইত? বাস, ট্রেন, মেট্রো রেলে প্রতিবন্ধী আসন সংরক্ষিত রহিয়াছে। কিন্তু রেল স্টেশনগুলিতে সিঁড়ি ভাঙিবার বিকল্প নাই, বাস কিংবা মেট্রো হুইলচেয়ারের উপযোগী নহে। তাঁহাদের উঠিবার ব্যবস্থা কী হইবে? ইদানীং কোনও কোনও সরকারি দফতর বা কার্যালয়ে ঢুকিবার ‘রাম্প’ নির্মিত হইয়াছে, কিন্তু প্রবেশের পর সিঁড়ি ব্যতীত উঠিবার উপায় নাই। বহু দফতরে প্রতিবন্ধীদের উপযোগী শৌচাগারও নাই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের উপযোগী ব্যবস্থাও অতি সামান্য। সর্বাধিক উপেক্ষিত মানসিক প্রতিবন্ধীরা।
ভরসা কিছু ব্যতিক্রমী পূজা। কলিকাতার একটি ক্লাব দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষ আয়োজন করিয়াছিল। প্রতিমা হইতে মণ্ডপসজ্জা, সকলই এমন ভাবে নির্মিত যাহাতে স্পর্শের দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায়। সাধু উদ্যোগ। পূজার মধ্যেই খবর মিলিয়াছে, ভাঙড়ের একটি গ্রামে স্থানীয় মানুষদের সহিত মিশিয়া বসবাস শুরু করিয়াছেন সুস্থ-হইয়া ওঠা মানসিক রোগীরা। জীবনের মূলস্রোত হইতে প্রতিবন্ধীদের দূরে সরাইয়া রাখা অপরাধ, সেই বোধ যত দৃঢ় হয়, ততই মঙ্গল। যাহা সকলের, তাহার পরিকল্পনায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকদের প্রয়োজনটিও মাথায় রাখিতে হইবে বইকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy