একটি সামান্য কারণে বিক্ষোভ প্রদর্শন। এবং পরিণতি— দুইটি তরতাজা ছেলের মৃত্যু, বিপুল রাজনৈতিক তরজা আর একটি বাংলা বন্ধ। রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরিবার প্রবণতাটির সাক্ষাৎ প্রমাণ এই ঘটনার পরতে পরতে। কিন্তু তাহার পাশে বলিতে হয় প্রশাসনের সম্পূর্ণ অপদার্থতার কথাও। স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ লইয়া অসন্তোষ জমিতেছে, শিক্ষা দফতর তাহা জানিয়াও সক্রিয় হইল না। বিক্ষোভ হইবে, পুলিশের নিকট সেই সংবাদ কি পূর্বে পৌঁছায় নাই? পুলিশ যদি গুলি না-ও চালায়, গুলি তো চলিয়াছে। স্কুলের বিক্ষোভে বন্দুক-পিস্তল জড়ো হইতেছে, অথচ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তাহা টেরও পাইল না? যখন টের পাইল, তখনই পরিস্থিতি সামলাইতে এতটা মারমুখী হইতে হইল? কেহ ব্যাখ্যা দিতে পারেন যে, ইসলামপুরে যাহা হইল, তাহা স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ছিল না, বরং ছিল গোলমাল পাকাইয়া তুলিবার, এবং তাহাতে বিবিধ রঙ চাপাইবার সুকৌশল প্রয়াস। কথাটির সত্য-মিথ্যা বিচার তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু, কোনও তদন্ত ছাড়াই এইটুকু বলা যায় যে গোলমাল পাকাইবার চেষ্টাকে বানচাল করিয়া দেওয়ার কাজটিও প্রশাসনেরই। তাহার জন্য লাঠিবন্দুক হাতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া গোলমাল তুঙ্গে তুলিবার দরকার নাই, বরং ঝামেলা বাঁধিবার পূর্বেই তাহাকে সামাল দিবার কথা। যাঁহারা বলিবেন, রাজনীতির গোলমালকে প্রশাসনিক ব্যবস্থার দ্বারা ঠেকানো কার্যত অসম্ভব— তাঁহাদের স্মরণ করানো যায়, রাজনৈতিক সমাধানসূত্র বলিয়াও একটি কথা আছে। এ সব পরিচিত পদ্ধতিগুলি উড়াইয়া দেওয়ার নহে, যদি না গোলমাল হাতের বাহিরে লইয়া গিয়া তাহা হইতে প্রশাসনেরও কিছু ফললাভের আশা থাকে। দুর্জনে বলিতে পারে, এ রাজ্যে যে হেতু অষ্টপ্রহর নেতাদের ধামা ধরিতেই সময় কাটিয়া যায়, পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্তারা এই সূক্ষ্ম কাজগুলি করিবেন কখন।
ঘটনার জেরে বিজেপি বাংলা বন্ধ ডাকিতেছে। উর্দুর পরিবর্তে বাংলা ভাষার স্বার্থরক্ষার্থে মিছিলও বাহির করিতেছে। হঠাৎ বাংলা ভাষার প্রতি এ হেন ভালবাসার কারণ সন্ধান করিতে বসিলে কী পাওয়া যাইবে, দিলীপ ঘোষরাও বিলক্ষণ জানেন। কারণটি গোপন রাখিতেও তাঁহাদের বিশেষ আগ্রহ নাই। তাঁহারা দ্রুত রাজনীতির ঘোলা জলে সাম্প্রদায়িক মাছ ধরিতে নামিয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু জলটি যে এতখানি ঘোলা হইল, সে ‘কৃতিত্ব’ রাজ্য সরকারেরই। প্রশাসনিকতার প্রশ্নগুলিকে রাজনীতির চশমা দিয়া দেখিবার কু-অভ্যাস তাঁহাদের ডুবাইতেছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেরও আভাস মিলিতেছে। অনুমান করা চলে, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার অন্তত আংশিক কারণ এই দ্বন্দ্বেই মিলিবে। কোনও রাজনৈতিক প্রশ্নকেই তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব না দেওয়ার অভ্যাস ক্রমে শাসক দলের মজ্জাগত হইতেছে। ইসলামপুরের ঘটনাটি বিরোধীদের চক্রান্ত হইতেই পারে। কিন্তু, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত না হইলে যে কোনও ‘চক্রান্তের’ বাস্তবায়ন সম্ভব হইত না, এই কথাটি অস্বীকার করা যায় না। মানুষ কেন ক্ষুব্ধ, তাহাতে শাসক দলের ভূমিকা কতখানি, তাহার উত্তর শাসকদেরই খুঁজিতে হইবে, কেবল অপরের উপর দোষ চাপাইয়া গেলে তাঁহাদেরই আখেরে ক্ষতি। ক্ষতি কী ও কেমন, বুঝিতে গেলে ভাবা জরুরি যে, একটি স্কুলছাত্রের মরদেহ বিজেপির পতাকায় মুড়িয়া দেওয়ার মতো ঘটনা কেন ঘটে। মৃত নাবালক ছাত্রটির মৃতদেহকে ঘিরিয়া যে বিরাট ভিড়, তাহার অন্তত একাংশের নিকট বিজেপির পতাকাটিই ক্রমে প্রতিবাদের প্রতীক হইতেছে। ইসলামপুরকে কেন্দ্র করিয়া বিজেপির রাজনীতি কোন পথে হাঁটিতেছে, মুখ্যমন্ত্রী জানেন। আশা করা যায়, ইহাও তিনি জানেন যে, সেই বিপজ্জনক পথটিই রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির মূল পথ হইয়া উঠিলে, মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য পথ হইয়া উঠিলে, তাহার দায় তৃণমূল সরকারকেই লইতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy